আমার ভোট আমি দিতে পারবো তো?
র্বাচন নিয়ে সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টালিনের একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। স্টালিন বলেছিলেন- “দেশের জনগণের জন্য এটা জানাটাই যথেষ্ট যে দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যারা ভোট দেয় তারা কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় না। যারা ভোট গণনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে তারাই সিদ্ধান্ত নেয় ফলাফল কী হবে।”
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলোতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সেই নির্বাচনগুলো ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্থান পেয়েছিল। এর পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের শেষ দুটি জাতীয় নির্বাচনে তৈরি হয় ভিন্ন প্রেক্ষাপট। ২০১১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পক্ষে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায়কে ভিত্তি ধরেই সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে মহাজোট সরকার। শুরু হয় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন।
ঘনিয়ে আসছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বহুল আলোচিত এ নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। বেশ কয়েকটি দলের প্রার্থী ভোটে অংশ নিলেও ভোটের যুদ্ধটা হবে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে। দেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী এ দুদলের মেয়র প্রার্থীরা দিনরাত গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। নৌকা ও ধানের শীষে ভোট চাইতে নেতাকর্মীদের নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। সব মিলিয়ে ঢাকা সিটি নির্বাচন ঘিরে রাজধানীতে এখন জমজমাট ভোটের রাজনীতি।
এরই ফাঁকে উঁকি মারছে সন্দেহ, প্রশ্ন আর আশঙ্কা। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, ভোট এলেই ভোটারদের মর্যাদা বাড়ে, মূল্যায়ন বাড়ে। হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মেলানো আর কোলাকুলির মহোৎসব শুরু হয়। কিন্তু ব্যালটে সিল মারার পর ভোটার তথৈবচ! প্রার্থী কিংবা বিজয়ীর সঙ্গে মুহূর্তেই যোজন যোজন দূরত্ব বেড়ে যায় সাধারণ ভোটারদের। তারপরও স্থানীয় কিংবা জাতীয় যেকোনও নির্বাচন এলেই ভোটারদের মাঝেও উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়ে। প্রত্যেকেই নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে চায়।
কিন্তু বাংলাদেশে সবশেষ কয়েক বছর বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনী যে হালচাল তা থেকে নেয়া শিক্ষা ভাবিয়ে তুলেছে ঢাকা সিটির ভোটারদেরও। ভোটারদের মনে প্রশ্ন জাগছে- ‘আমার ভোট আমি দিতে পারবো তো?’ আর এই সন্দেহের বড় কারণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিতর্ক। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে প্রায় সব বিরোধী শিবির থেকেই একটি অভিযোগ প্রবলভাবে উঠে এসেছিল একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ভোট পরবর্তী ফলাফল নিয়ে। আর সেটি হচ্ছে ‘আগের দিন রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা’।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে একতরফা জয় নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বিএনপি সেই নির্বাচনকে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ‘কলঙ্কজনক’ নির্বাচন বলে আখ্যা দেয়। নির্বাচন পরবর্তী ভোট বাতিলের দাবি উঠে। নতুন নির্বাচনের দাবি উঠে। কিন্তু এর কোনোটাই কার্যকর হয়নি। উল্টো দেখতে দেখতে বর্তমান মেয়াদের আরও একটি বছর দাপদের সঙ্গেই পার করে দিলো আওয়ামী লীগ।
একাদশ নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়েও বেশি হতাশ হয়েছিল দেশের সাধারণ ভোটাররা। দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রেই ছিল ভোট ডাকাতির মহড়া। ভোটাররা সকালে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখে তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। কারা দিলো তাদের ভোট? কার পক্ষে পড়লো কার ভোট? এসব প্রশ্ন যতোই বড় হয়ে সামনে আসলো কিছুতেই কিছু হলো না। হলো যেটা তা হলো- আড়াইশোরও বেশি আসন নিয়ে সরকার গঠন করলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার।
আগামী ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীরা এখন গণসংযোগে ব্যস্তিব্যস্ত। তারপরও প্রতিদিনই শঙ্কার কালো মেঘ উড়ছে বিশেষত বিএনপিপন্থিদের শিবিরে। আর সেটির বড় কারণ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। যেটাকে সংক্ষেপে বলা হয় ই-ভোটিং। ব্যালট-বাক্স বাদ দিয়ে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্তকে ‘ভোট চুরির নীলনকশা’ বলে অভিযোগ উঠেছে। এটাকে সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি বলা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে বেশ কিছু সংসদীয় আসনের কিছু কিছু কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। কিন্তু ইভিএম নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো আপত্তি তুললেও নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগ একমত। সরকার ও কমিশন বলছে, ইভিএম ভোটগ্রহণের সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটারের ভোট দিতে সময় লাগে মাত্র ১৪ সেকেন্ড। একটি মেশিনে প্রায় ৪ হাজার ভোট দেয়া যায়। থাকতে পারে সর্বোচ্চ ৬৪ জন প্রার্থীর তালিকা। একইসঙ্গে একজন ভোটারের কোনোভাবেই একটি বেশি ভোট দেয়ার সুযোগ থাকে না এ পদ্ধতিতে। আর ভোটগণনাও হয়ে যায় যখন-তখন।
নির্বাচন কমিশন বলছে, ইভিএমে ভোটগ্রহণের সঠিক কৌশল জানানোর জন্য পোলিং এজেন্ট ও রিটার্নিং অফিসারদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এটা ঠিক যে এই ইভিএম ও এর প্রশিক্ষণ খাতে ইসি কাড়ি কাড়ি টাকা ইতোমধ্যে খরচ করে ফেলেছে। কিন্তু দেশের সাধারণ জনগণ কি এই ইভিএম সিস্টেম রপ্ত করতে পেরেছে? ‘শর্ষের ভেতর ভুত’ থাকার মতো ইভিএমে ভেজাল হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? বরং সাম্প্রতিক দু-একটি উপনির্বাচনে এই ইভিএমই হয়েছে ভোটারদের মূল বিড়ম্বনা।
নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। গোটা বিশ্বে গত আড়াইশো কি তিনশো বছর যাবত আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গন্ত্রতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক ও সর্বোত্তম প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন আসতেই পারে। কিন্তু সেই পরিবর্তন বা সংস্কার যদি হয় প্রশ্নবিদ্ধ, যদি সেটি না হয় সবজনস্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্য তবে তা অর্থহীন, তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে নির্বাচনী সংস্কারে নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপের বিকল্প কিছু হতে পারে না। অন্যথায় ভোট নিয়ে ভোটারের বিপত্তি, বিড়ম্বনা আর অনীহা উত্তরোত্তর বাড়বেই। আর তাতে শক্তি, সামর্থ্য আর আস্থা হারাবে নির্বাচনী সংস্কৃতি।