ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ধোঁকা

0

১৯৪৩ সাল। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি অধিকৃত ইউরোপে হিটলারের বলয় ভাঙতে মরিয়া অক্ষশক্তি। সিসিলিতে সর্বাত্মক আক্রমণের পরিকল্পনা। তবে কীভাবে সম্ভাব্য ভয়ানক এক গণহত্যা থেকে একটি বিশাল আক্রমণকারী শক্তিকে রুখে দেওয়ার মতো দুঃসাহসিক অভিযানের পরতে পরতে অসম্ভব সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বহুমাত্রিক যোদ্ধারা। ইওয়েন মন্টাগু এবং চার্লস চোলমন্ডেলির নামক দুই গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা কর্মকর্তা একজন মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে অনুপ্রাণিত হন এবং সবচেয়ে চৌকস ও বিভ্রান্তিমূলক কৌশলের স্বপ্ন দেখেন। সিসিলিতে মিত্রবাহিনীর আক্রমণের বিপরীতে ব্রিটিশ বাহিনীর সফল গোপন এ অভিযানের নাম ‘অপারেশন মিনসমিট’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ অভিযান ‘অপারেশন মিনসমিট’ নিয়ে রচিত জনপ্রিয় লেখক বেন ম্যাকিনটায়ারের একই নামের বইয়ের ওপর ভিত্তি করে পরিচালক জন ম্যাডেন নির্মাণ করেছেন যুদ্ধনির্ভর অসাধারণ এক ছবি ‘অপারেশন মিনসমিট’। মিশেল অ্যাশফোর্ডের চিত্রনাট্যে সত্য ঘটনায় নির্মিত এ ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন- কলিন ফার্থ, কেলি ম্যাকডোনাল্ড, ম্যাথিউ ম্যাকফ্যাডিন, পেনেলোপ উইনটন, জনি ফ্লিন, সায়মন রাসেল বিয়েল, জেসন আইজ্যাকস, পল রিটার, মার্ক গ্যাটিস, উইল কিনসহ অনেকেই।

২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটির বিশ্ব প্রিমিয়ার হয়। এ বছর ১৫ এপ্রিল ওয়ার্নার ব্রাদার্স পিকচারসের ব্যানারে যুক্তরাজ্যে গতকাল উত্তর আমেরিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। এবার সবার জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে ছবিটি। বিশ্বব্যাপী মুক্তির অনেক আগেই ইউটিউবে প্রকাশিত হয়েছে ছবির ট্রেলার; যার শুরুতেই সিসিলির সাগরের দক্ষিণ উপকূলে আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায় যোদ্ধাদের। আক্রমণ পাল্টা-আক্রমণের নকশা রচনা করে উভয় শক্তি। অক্ষশক্তিকে পরাজিত করার প্রতিজ্ঞা নেয় মিত্রশক্তি। ব্রিটিশ গোয়েন্দার দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একটি মৃতদেহ পেয়েছিলেন, যিনি ইঁদুরের বিষ খেয়ে মারা গিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে স্পেন থেকে তাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু। দুই ব্রিটিশ জেনারেলের মধ্যকার চিঠি আদান-প্রদানের তথ্য ও গ্রিস এবং সার্ডিনিয়া আক্রমণের পরিকল্পনার মিথ্যা ছক মৃত দেহে জুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন তারা। মৃত সেই ব্যক্তিকে রয়্যাল মেরিন অফিসারের পোশাক পরিয়ে কাল্পনিক ক্যাপ্টেন উইলিয়াম মার্টিন হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তার লাশ ব্যক্তিগত জিনিসপত্রসহ পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। লাশের সঙ্গে অভিনব কায়দায় নকল ডকুমেন্ট আসল রূপে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার কৌশল ছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ধোঁকা। পরিকল্পিত এই ফাঁদে পা দেয় জার্মান যোদ্ধারা। লাশটি পানি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান তারা এবং সঙ্গে থাকা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে শুরু হয় তুমুল গবেষণা। গবেষণায় বেরিয়ে আসে শুত্রুর সাজানো পরিকল্পনা। সেই মিথ্যা পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণের ছক তৈরি করেন অক্ষশক্তি। এভাবেই এগিয়ে চলে ছবির গল্প।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনার পেক্ষাপট ‘অপারেশন মিনসমিট’ ঘিরে চিত্রিত হয়েছে ছবির নানা দৃশ্যপট। সিসিলিতে মিত্রবাহিনীর আক্রমণের পরিকল্পনা গোপন রাখার জন্য একটি প্রতারণার প্রচেষ্টা ঘিরে রচিত হয়েছে। সিনেমার প্লট তৈরিতে অসাধারণ দক্ষ দেখাতে সক্ষম হয়েছেন পর্দার পেছনের কারিগররা।

ঐতিহাসিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার আংশিক চিত্রায়ণের আবহ পর্দায় ভেসে উঠবে। ১৯৪৩ সালে ‘বিগ থ্রি’ জোশেফ স্ট্যালিন, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও উইনস্টন চার্চিলের চিত্র রূপায়ণ থাকলেও মূলত ব্রিটিশ ও জার্মান যুদ্ধকৌশল বেশি প্রাধান্য পেয়েছে এতে। উইনস্টন চার্চিল হিসেবে সায়মন রাসেল বিয়েলকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি অন্য কেউ। তার মতো অন্য চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলা হয় দারুণ দক্ষতায়।

২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ইংল্যান্ড, স্পেন ও মালাগার বিভিন্ন স্থানে চলে প্রধান ফটোগ্রাফির কাজ। মঞ্চ, চলচ্চিত্র, টেলিভিশনসহ বহুমাত্রিক জনপ্রিয় ইংরেজ পরিচালক জন ফিলিপ ম্যাডেন ১৯৯৮ সালে ‘শেকসপিয়র ইন লাভ’ পরিচালনার মধ্য দিয়ে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছিলেন। যেটি সেরা ছবির জন্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়াও তার ঝুলিতে জমা পড়েছে নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। এবার তার অনন্য প্রয়াস অপারেশন মিনসমিট।

ছবিটি পেছনের সত্য কাহিনি অপ্রতিরোধ্য, অপরিচিত-কাল্পনিকতাকেও হার মানায়। এই গল্পে আগ্রহ নতুন কোনো বিষয় নয়। একই গল্পে ১৯৫৬ সালের রোনাল্ড নেমের পরিচালনায় ‘দ্য ম্যান হু নেভার ওয়াজ’ চলচ্চিত্রে একবার পর্দায় আনা হয়েছিল। তবে এবার সর্বশেষ রূপান্তরে গল্পের একটি সরল, স্থির সংস্করণ উপস্থাপিত হয়েছে। একটি ঐতিহাসিক উপাদানকে জীবন্ত করে তুলে ধরা হয়েছে। গোপন এই অপারেশনের গল্প যে কোনো দর্শককে আকর্ষণ করতে বাধ্য। ইংরেজি ভাষার ২ ঘণ্টা ৮ মিনিটের ছবিটির গভীরে প্রবেশ করলে মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে এমনটাই মনে হচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অক্ষশক্তির আক্রমণ নিজেদের রক্ষার তাগিদে ও প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের বিপরীতে মিত্রশক্তি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সে সময়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন দর্শক। ঐতিহাসিক-গোয়েনা কাহিনি ও যুদ্ধনির্ভর ছবিতে যাদের আগ্রহ তাদের জন্য এটি অসাধারণ এক সংযোজন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com