গ্রামে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে
সাধারণত শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে শহরের চেয়ে গ্রামেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি। গত ১৪ মাস ধরেই শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। অবশ্য মাঝে এক মাস কমেছিল। কিন্তু পরের মাসে আবার আগের অবস্থায় ফিরেছে। প্রায় তিন বছর ধরে এভাবেই চলছে।
এতে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় শহরের চেয়ে অধিক হারে বাড়ছে। তবে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে গড় হিসাবে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কম ছিল।
এ প্রসঙ্গে গবেষকরা জানান, নিত্যপণ্যের জোগানে খরচ বেশি। বেশির ভাগ পণ্যই শহর থেকে যাচ্ছে গ্রামে। কৃষিভিত্তিক নিত্যপণ্যের উৎপাদন গ্রামে হলেও মজুদ গড়ে উঠছে শহরে। উৎপাদনের পরপরই সেগুলোর বেশির ভাগই কৃষকের হাত থেকে চলে যাচ্ছে জমুতদারদের নিয়ন্ত্রণে। তারা কম দামে কিনে বেশি দামে গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করছে। এতে পরে নিজের উৎপাদিত পণ্যই বাড়তি দামে কিনছে কৃষক। এসব কারণেই মূল্যস্ফীতির হার গ্রামে অধিক হারে বাড়ছে।
এ ছাড়া রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি যাচ্ছে গ্রামে। এগুলোর ৫৩ শতাংশই ভোগ বিলাসে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। মূলত এ দুটি কারণেই গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, গত মার্চে শহরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গ্রামের হয়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত টানা ১৪ মাস শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে এ হার গ্রামে সামান্য কম ছিল। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গ্রামে বেশি ছিল।
গবেষকদের মতে, শীতে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম থাকার কথা। ওই সময়ে গ্রামে ধানসহ শাকসবজির উৎপাদন বেশি হয়। এগুলোর সরবরাহও কম থাকে। এ হিসাবে মূল্যস্ফীতির হারও কমার কথা। কিন্তু তা সার্বিকভাবে কমে না। তখনও শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি থাকে। গত শীতে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কমেছে। তবে শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি বেড়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শুধু শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম ছিল।
এর আগের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের গড় হিসাবে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম ছিল। ওই অর্থবছরে গ্রামে এ হার ছিল ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং শহরে ছিল ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ। এর পরের বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে শহরের চেয়ে গ্রামে এ হার দশমিক ০৫ শতাংশ কম ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে। এর মধ্যে মোট আমানতের ৭৯ শতাংশ শহর থেকে ও ২২ শতাংশ গ্রাম থেকে আসছে। মোট ঋণের ৯১ শতাংশ দেওয়া হয় শহরে ও গ্রামে ৯ শতাংশ। বিশেষ করে ঋণের একটি অংশ যাচ্ছে গ্রামে। এছাড়া কৃষি, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ও রেমিট্যান্স প্রবাহ গ্রামেই যাচ্ছে বেশি। এসব অর্থের একটি বড় অংশই অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে যা মূল্যস্ফীতির হারকে উস্কে দিচ্ছে।
গ্রামে খাদ্যপণ্যের চাহিদাই বেশি। খাদ্যবহির্ভূত অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কম। একই সঙ্গে গ্রামে খাদ্যের সরবরাহ বেশি হওয়ার কথা, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের সরবরাহ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা উলটো। গ্রামে সার্বিকভাবে খাদ্যের সরবরাহ বেশি হলে মজুতদারদের কারসাজির কারণে দাম বেশি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের জোগান স্বাভাবিক থাকলেও ব্যয়সাপেক্ষ। যে কারণে গ্রামে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেশি।
গত বছরের মার্চের তুলনায় এবারের মার্চে শহরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। কিন্তু গ্রামে এ হার ৬ দশমকি ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে ১ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে একই সময়ে শহরে এ হার ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। কিন্তু গ্রামে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে এ হার দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আগে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম ছিল। গত কয়েক বছর ধরে হঠাৎ করেই গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার অধিক হারে বাড়ছে। এর একটি কারণ হতে পারে-নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকার শহরে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্য বিতরণ করছে। গ্রামে সেটি শহরের মতো ব্যাপক হারে করছে না। গ্রামে উৎপাদিত পণ্যের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে মজুতদারদের দখলে। তারা সময়মতো বাড়তি দামেই পণ্য বিক্রি করছেন। গ্রামে পণ্য উৎপাদন হলেও ভোক্তারা কম দামে পণ্য পাচ্ছেন না। আরেকটি কারণ হতে পারে গ্রামে এখন বাড়িঘর নির্মাণ হচ্ছে বেশি। যারা প্রবাসী বা উঠতি ধনী তারা অনুৎপাদনশীল খাতে বেশি ব্যয় করছেন।
তিনি আরও বলেন, শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ার কথা নয়। বরং শহরেই এ হার বেশি হওয়ার কথা। এখন দেখতে হবে সমস্যা কোথায়। মনে হচ্ছে, পণ্যের জোগান ও সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়ছে।
জীবনযাত্রার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এখনো গ্রামের চেয়ে শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যেভাবে গ্রামে অব্যাহত গতিতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে চলেছে, এটা অব্যাহত থাকলে শহরের চেয়ে গ্রামে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। এটা গ্রামের মানুষের জন্য ভালো হবে না। কারণ শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় কম। তখন গ্রামেও আয় বাড়াতে হবে যা বেশ কঠিন হবে।
বিবিএস জীবনযাত্রার সব ধরনের উপকরণ, সেবার মূল্য ও চাহিদা বিশ্লেষণ করে প্রতি মাসে এগুলোর দাম বৃদ্ধি বা কমার ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করে। এতে খাদ্য, পানীয়, টোব্যাকো, পোশাক পরিচ্ছদ, জুতা, বিভিন্ন সেবার মূল্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, ফার্নিচার, অন্যান্য গৃহসজ্জা, গৃহসামগ্রী, চিকিৎসা ব্যয়, পরিবহণ, বিনোদন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবার মূল্যসহ জীবনযাত্রার প্রায় সব ধরনের উপকরণ থাকে। এগুলোর সমন্বয়ে একটি সূচক তৈরি করে। এতে খাদ্যপণ্যের ওপর ভর থাকে অর্ধেকের বেশি এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে থাকে অর্ধেকের কম।
বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মানুষের জীবনযাত্রায় খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মধ্যে কাপড়, জুতা, পরিবহণ, বিনোদন ও বিবিধ খাতে শহরের চেয়ে গ্রামে ব্যয় বেশি বেড়েছে। গত বছরের মার্চের তুলনায় এ বছরের মার্চে কাপড় ও জুতার দাম গ্রামে বেড়েছে দশমিক ৬২ শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমিক ৪৬ শতাংশ। গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি বেড়েছে দশমিক ১৬ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে গ্রামে পরিবহণ খাতে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৩২ শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি বেড়েছে দশমিক ১৫ শতাংশ। বিনোদন খাতে একই সময়ে গ্রামে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৭৮ শতাংশ, শহরে বিনোদনের সঙ্গে শিক্ষা যুক্ত করে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি বেড়েছে দশমিক ৪৬ শতাংশ। বিবিধ খাতে গ্রামে ব্যয় বেড়েছে দেড় শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমকি ৭১ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে ব্যয় বেশি বেড়েছে ৭৯ শতাংশ।
অন্যদিকে বাড়ি ভাড়া, জ্বালানির ব্যবহার, গৃহসামগ্রী, চিকিৎসা খাতে ব্যয় গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি হারে বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গ্রামে পরিবহণ ব্যয় শহরের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। যে কারণে এ খাতে মানুষকে বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। শহরে সর্বনিু ১০ টাকা ভাড়ায় বাসে যাতায়াত করা সম্ভব হলেও গ্রামে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে গ্রামে সর্বনিু ভাড়া দিতে হয় ২০ টাকা। শহরে গণপরিবহণের কাঠামো গড়ে উঠলেও গ্রামে সেটি হয়নি। গ্রামে বিনোদনের কাঠামো নেই। শিক্ষার কাঠামোও দুর্বল।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রামে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। কিন্তু যোগাযোগ কাঠামো এখনো ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। যে কারণে পরিবহণ খরচ বেশি পড়ে। পণ্য পরিবহণেও খরচ বেশি। এতে শহর থেকে যেসব পণ্য গ্রামে যায় সেগুলোর দাম বেশি। এ কারণে এখন গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে। এছাড়া আধুনিকতা ছোঁয়ার কারণে গ্রামেও এখন টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, ফ্রিজ এসব পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে। তবে এগুলোর ব্যবহার শহরের চেয়ে বেশি বাড়েনি। গ্রামে যে কেন মূল্যস্ফীতির হার অধিক বাড়ছে এটা খতিয়ে দেখা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজারে ভোজ্যতেল, মসলা, চিনি ও মোটা চালের দাম বাড়ার কারণে খাদ্য উপসূচকে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়েছে। এসব কারণে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
সূত্র জানায়, ভোজ্যতেল, মসলা, চিনি, কাপড়, জুতা, বিনোদনের উপকরণ সবই শহর থেকে গ্রামে যায়। ফলে এসব পণ্যের দাম শহরের থেকে গ্রামে বেশি। যে কারণে এসব খাতে মূল্যস্ফীতির হারও গ্রামে বেশি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্রামে এবারের চিত্রটা একটু ভিন্ন। কৃষিপণ্যের দাম বাড়ায় গ্রামের মানুষ উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পাচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে।
তিনি বলেন, গ্রামে পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার আগাম পরিকল্পনা দরকার। তাহলে এ সমস্যা হবে না। এ ব্যাপারে বিদেশে কৃষি খাতে অভিজ্ঞতা নেওয়া যেতে পারে। অনেক দেশ এখন কৃষককে আগাম মূল্য দিয়ে পণ্য উৎপাদন করছে।