পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও এর নেপথ্যে

0

পাকিস্তানের সরকার সর্বাত্মকভাবে চীন-রুশ অক্ষে চলে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা শক্তি ইসলামাবাদে সরকার পরিবর্তনের কলকাঠি নাড়তে শুরু করে। তাদের নেপথ্য সমর্থন বিভক্ত বিরোধী দলকে এক সারিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ইমরান খান তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার এই আয়োজন সম্পর্কে জানতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান সেটিকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে পারেননি তিনি। এর ফলে এক এক করে পাকিস্তানের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক স্থানগুলো তার হাতছাড়া হতে থাকে। পশ্চিমা অর্থনৈতিক বিধিনিষেধের ঝুঁকিতে পড়ে পাকিস্তান। দেশটির সামরিক এস্টাবলিসমেন্টের পক্ষেও ইমরান সরকারকে টিকাতে ভূমিকা রাখার মতো বাস্তব অবস্থা থাকেনি।

ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ওঠার পর অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব অবৈধ ঘোষণার পর ইমরানের পরামর্শে সংসদ ভেঙে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। সংসদ ভেঙে দেয়ার পর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত ইমরান ১৫ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে প্রক্রিয়া তাতে সরকারি দল ও বিরোধী দলকে একমত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী ঠিক করতে হবে। সেটি ব্যর্থ হলে পর্যায়ক্রমে সেটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব অর্পিত হবে সংসদের স্থায়ী কমিটি, নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের ওপর। সংসদ ভেঙে দেয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যেই নতুন নির্বাচন হতে হবে।

সংসদ ভেঙে দেয়ার পদক্ষেপ চ্যালেঞ্জ করে বিরোধী নেতারা এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ সংক্রান্ত স্বতঃপ্রণোদিত নোটিশ ও রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের শুনানির জন্য পাঁচ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেছেন। এর মধ্যে শুনানি শুরু হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ সংবিধানের ৬৩(অ) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা চেয়ে রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের শুনানি করবে। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ বিবেচনায় জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকারের তা খারিজ করাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সাংবিধানিক সঙ্কটের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির নেয়া স্বতঃপ্রণোদিত নোটিশের ওপরও শুনানি হচ্ছে।

প্রধান বিচারপতি বান্দিয়াল নোটিশ গ্রহণ করে বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভির যে কোন আদেশ ও পদক্ষেপ এই আদালতের আদেশের সাপেক্ষে কার্যকর হবে। প্রথম দিনের শুনানিতে পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেল খালিদ জাভেদ খান, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসান ভুন এবং বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যান্য আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। আগের দিন রোববার সন্ধ্যায় শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেল খালিদ জাভেদ খান এবং প্রতিরক্ষা সচিবকে নোটিশ জারি করেন এবং স্বরাষ্ট্র সচিবকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। সুপ্রিম কোর্ট জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাবের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে এই মামলায় উত্তরদাতা হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। একই সাথে তাদের আইন পালন এবং শান্তি ও জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট চাইলে এখন ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আর নেপালের মতো সংসদ বিলুপ্তিকে অবৈধ ঘোষণা করে সংসদ পুনর্বহাল ও অনাস্থা কার্যক্রম চালুর রায় দিলে বিরোধী জোট সরকার গঠন করতে পারবে। এতে পাকিস্তানের রাজনীতি আমূল পাল্টে যাবে। পাকিস্তানের গভীর ক্ষমতা বলয় এটি চায় বলে মনে হয় না। সেটি হলে ইমরান খান ও তার দলের ওপর প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপও চলতে পারে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়ে ইমরানকে জেলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বিরোধী দলগুলো। বিরোধী নেতাদের মধ্যে কে প্রধানমন্ত্রী কে প্রেসিডেন্ট আর কে স্পিকার হবেন সেসব বিষয়ও নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল।

আদালতের প্রথম দিনের শুনানি অনুসরণ করলে শুনানির তিনটি সম্ভাব্য ফলাফল আসতে পারে বলে মনে হয়। প্রথমত, বিরোধী নেতাদের আশা অনুযায়ী, আদালত দ্রুত ইমরান খানের সিদ্ধান্ত বাতিল করবেন এবং অনাস্থা ভোটের আদেশ দেবেন। একই সাথে আদেশ দেয়া হতে পারে অবিলম্বে সংসদের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য। দ্বিতীয়ত, আদালত একটি মধ্যম স্থল বেছে নিতে পারে, এতে আদালত শাসক দলের পদক্ষেপ অসাংবিধানিক ছিল বলে ঘোষণা করবে কিন্তু বিলুপ্ত ঘোষিত সংসদ পুনরুদ্ধার করা বা অনাস্থা ভোটের অনুমতি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হবে না। তৃতীয় সম্ভাবনা হলো, আদালত সংসদীয় কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করতে পারে, যা কার্যকরভাবে ইমরান খানের পদক্ষেপকে সমর্থন করবে এবং ৯০ দিনের মধ্যে আগাম নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করবে।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কী চায়?

সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন এবং জাতিকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, ২৭ রমজানে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে এবং এ জাতি কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবে না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে, গণতন্ত্রীরা জনগণের কাছে যায়, নির্বাচন হয় এবং জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় তারা কাকে শাসক করতে চায়।

এত সব ঘটনার পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল বাবর ইফতেখার বলেছেন, যা হয়েছে তার সাথে সেনাবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। এই প্রথম সামরিক নেতারা এত খোলাখুলি বলেছেন যে তারা ইমরান খানের পদে থাকার দাবি সমর্থন করেননি। কারো কারো মতে, রাজনৈতিক সঙ্কট চলতে থাকলে তা সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।

এর আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার দেশের একটি ‘চমৎকার’ সম্পর্ক রয়েছে এবং চীনের সাথে একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষতি না করে তা প্রসারিত করতে চায় তার দেশ। এই বক্তৃতায়, জেনারেল বাজওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্ঘাতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নিরপেক্ষতার অবস্থান থেকে সরে যান। ‘রাশিয়ার বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগ’ স্বীকার করার পরও তিনি জোর দেন যে, একটি ছোট দেশের বিরুদ্ধে মস্কোর আগ্রাসন ক্ষমা করা যায় না।

বিদেশী ষড়যন্ত্র ও এর প্রভাব
ইমরান খান তার দল থেকে একাধিক এমপির পক্ষত্যাগের পর তার সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর মুখে পড়লে বারবার দাবি করেন যে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পদক্ষেপের পেছনে একটি ‘বিদেশী-সমর্থিত ষড়যন্ত্র’ ছিল। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিদেশী অর্থ লোকদের কেনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

বলা হচ্ছে, ইমরান খান পদত্যাগ ও অনাস্থার মুখোমুখি হওয়া আর নতুন নির্বাচন দেয়া- এই তিন বিকল্পের মধ্যে শেষটি বেছে নিয়েছেন। কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিরোধী দলগুলো পাকিস্তানে নতুন নির্বাচন দাবি করে আসছিল। সে বিষয়ে ইমরান একমত হওয়ার পরও বিরোধী জোট আর তাতে সম্মত না হয়ে সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখে। সংসদ ভেঙে দেয়ার পর এখন সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়।

সামরিক অ্যাস্টাবলিসমেন্টের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর জন্য কিছু করা কঠিন। তারা পাকিস্তানে সম্ভবত স্থিতি ফেরাতে চায়। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ দানের কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেটি না হলে তা হতে পারে নতুন নির্বাচিত সরকারের সময়। নতুন সেনাপ্রধান কে হবেন তার ওপর পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কিছুটা প্রভাবিত হতে পারে।

তবে পাশ্চাত্যের সাথে রাশিয়ার বর্তমানে যে সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে তা ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ হলেও আরো অনেক দূর যেতে পারে। চীন ও রাশিয়া বিকল্প অর্থনৈতিক ও বিশ্ব ব্যবস্থার দিকে এগোতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে ভারত পশ্চিমা বলয়ের সাথে না থাকলে পাকিস্তানকে কাছাকাছি রাখার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিশেষভাবে সক্রিয় হতে পারে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com