পণ্যমূল্য আকাশচুম্বী সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত
মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসাব বাস্তবতার সঠিক চিত্র নয় বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। কিন্তু সরকারি খাতায় খাদ্য-মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত। সব মিলে বলা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে পণ্যের দাম বেশি। বাজারে কারসাজি রয়েছে। সুশাসনের অভাবও রয়েছে। এর ফলে সুযোগসন্ধানীরা বেশি সুযোগ নিচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমেও টাকা চলে যাচ্ছে বাইরে। কাজেই খুবই সতর্কতার সাথে আমদানি-রফতানি দেখা দরকার সরকারকে। জ্বালানির দামের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে অর্থনীতিতে ধস নামবে।
সিপিডি কার্যালয়ে ‘পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে?’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি, বহিঃখাত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং খাত এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোকপাত করে সিপিডিসহ অন্যান্য বক্তারা এই অভিমত জানান।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো: তৌফিক ইসলাম খান। বক্তব্য রাখেন সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মূল্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, বুয়েটের শিক্ষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম তামীম, বিআইবিএমের অধ্যাপক আহসান হাবীব।
সিপিডির গবেষণাপত্র উপস্থাপনের সময় ফাহমিদা খাতুন বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়ও কম। কিন্তু এটা বাস্তবতার তুলনায় সঠিক চিত্র নয়। নি¤œ আয়ের মানুষের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও বেশ বেড়েছে।
তিনি বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একটি বাড়লে আরেকটি কমে। খাদ্য-মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। এক একটি পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে ১৫, ২০ ও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। তারপরও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিভাবে স্থিতিশীল? আমরা বাজারে সেটা লক্ষ করি না। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজের মূল্য যদি আলাদাভাবে দেখি, তাহলে দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে যায়। তারপরও দেখি মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে গড়ে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রকৃত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। অন্য দিকে খাদ্য ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ওই সময়ে আয় ৫৩ শতাংশ কমে ৪৬ শতাংশ হয়েছে। এখানে দেখা গেছে, আয় বাড়লেও প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে তিন ধরনের চালের (মিনিকেট, পাইজাম ও মোটাচাল) দাম বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে, চালের বাজার ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের তুলনায় অনেক ঊর্ধ্বমুখী। একইভাবে ময়দা, চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, পাউডার মিল্ক, ডিম ও মাংসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি ফারাক। অসম্ভব বেড়েছে এসব পণ্যের দাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধির কারণই একমাত্র দায় নয়।
তিনি বলেন, বিপরীতে আমরা দেখতে পাই, সিগারেটের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। স্বাস্থ্যহানিকর পণ্য হিসেবে কর বৃদ্ধি করে করের আওতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। যদিও এখন বেশি আছে, কিন্তু আরো বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। সে জন্য সিপিডি নিত্যপণ্যের সরবরাহ যাতে যথেষ্ট থাকে সেটার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়। পাশাপাশি কিছু পণ্যে বাজারে মনোপলির একটি প্রবণতার কথা তুলে ধরে।
ফাহমিদা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ দেখি না। বিশেষ করে সঙ্কটের সময় কয়েকটি আমদানিকারক ও বিক্রেতাকে বেশি সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থাও জরুরি। সরকার চেষ্টা করছে, যদিও তা যথেষ্ট নয়। এর পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রক্রিয়াটি দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। সঙ্কট পরিস্থিতিতে নগদসহায়তা চালু রাখা যেতে পারে। বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারকে বেশি নজর দিতে হবে।
সিপিডি জানায়, রফতানি বাড়ছে, কিন্তু সে তুলনায় আমদানিও বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্য দিকে রেমিট্যান্সপ্রবাহও কমে গেছে। কয়েকটি পণ্য আমাদের ও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য। কৌশলের অংশ হিসেবে আগেভাগেই জ্বালানি তেলের মজুদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মূল্যও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেটা আরো বেড়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষে তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ৯৫ দশমিক ৮ ডলার ও মার্চে ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। যেখানে এক বছর আগেও ব্যারেল প্রতি ৬৫ ডলার ছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যুদ্ধ যদি না থামে সামনে দাম আরো বাড়বে।
সংস্থাটির মতে, সরকারি ব্যয় সুচিন্তিতভাবে করা দরকার। যে ধরনের প্রকল্পে মানুষের কর্মসংস্থান হয়, সে ধরনের ব্যয় করতে হবে। আর যতগুলো প্রকল্প চলমান, সেগুলো দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। অন্য দিকে দেশে ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি বেড়েই চলেছে। ব্যাংকগুলোকে ঋণখেলাপির বিষয়ে এক ধরনের শৈথিল্য দেয়া হয়। তারপরও এর উন্নতি হয়নি, বরং অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
সিপিডি নির্বাহী বলেন, এসব নিয়ন্ত্রণ করে বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত দরকার। সরবরাহ যাতে যথেষ্ট থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে, দক্ষতা ও সুচারুভাবে ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে বাজারব্যবস্থা। তিনি বলেন, সিগারেটের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রায় আট গুণ কম। নির্দিষ্ট একটি ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে দেখা যায় ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের মূল্য অস্ট্রেলিয়ার পার্থে দুই হাজার ৫১৬ টাকা, নিউজিল্যান্ডে দুই হাজার ১০৩ টাকা, ইংল্যান্ডে এক হাজার ৪৮৮ টাকা হলেও বাংলাদেশে মাত্র ৩০১ টাকা।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক লেনদেনের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ভারসাম্যে খুবই ফারাক দেখা দিয়েছে। গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই সাত মাসে ঋণাত্মক হয়েছে দুই বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার। যেখানে গত বছরের একই সময়ে ছয় বিলিয়ন ডলার প্লাসে (উদ্বৃত্ত) ছিল। এর ফলে রিজার্ভেও প্রভাব পড়েছে। কারণ ঘাটতি বলা যায় আট বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স দিয়েও এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব না। কারণ ইনফরম্যাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসছে দেশে। আবার আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমেও টাকা চলে যাচ্ছে বাইরে। কাজেই খুবই সতর্কতার সাথে আমদানি-রফতানি দেখা দরকার সরকারকে। এটা একটা অভিঘাত, অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার যদি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম না বাড়ায়, তাহলে অর্থনীতিতে চাপ আসবে না। কারণ এই চাপ সামলানোর মতো সক্ষমতা আছে। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে এখন পর্যন্ত যে ঘাটতি আছে, তা সহনীয়। এ ছাড়া সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তারল্য আছে। কাজেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে না।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হবে, তা সামাল দেয়া সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং এসব পণ্যের দাম বাড়ানো সঠিক হবে না। তিনি বলেন, ভর্তুকিতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকারকে কৌশলী হতে হবে। স্মার্ট বা চতুর নীতি গ্রহণ করতে হবে। চতুর ভর্তুকির অর্থ হলো যাদের জন্য ভর্তুকি প্রয়োজন, সেই টার্গেট গ্রুপ যাতে ভর্তুকি পায়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত।
অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। জিডিপি কমে যাবে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামবে। সরকারের এ পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে যতগুলো গ্যাস কোম্পানি আছে, কেউই লোকসানে নেই। সবাই লাভে আছে। তাদের উৎপাদনখরচে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি বলেন, জ্বালানির মূল্যের ব্যাপারে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে অর্থনীতিতে ধস নামবে।