আওয়ামী মন্ত্রীর ভাই যখন মি. ফিফটিন পার্সেন্ট
আওয়ামী লীগের কোনো নেতার দুর্নীতি নিয়ে বাইরের কেউ সমালোচনা করলে দলের নেতারা রইরই করে ওঠেন। সরকারের বদনাম করতে ও উন্নয়নের গতি থামিয়ে দিতে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে তাঁরা মাঠ গরম করেন। কিন্তু এবার সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বললেন, ফরিদপুর আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম সব কাজে ১৫ শতাংশ কমিশন নিতেন। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মি. ১৫ শতাংশ’ হিসেবে।
গত সোমবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুই হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার মামলার পলাতক আসামি খন্দকার মোহতেশামকে ঢাকার বসুন্ধরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, মোহতেশাম ফরিদপুরে যত দরপত্র হতো, সবটা থেকে কমিশন নিতেন। তিনি অবৈধ উপায়ে দেশে-বিদেশে প্রচুর সম্পদ করেছেন।
একই মামলার অভিযুক্ত অন্যান্য আসামি হলেন সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এপি এস এইচ এম ফুয়াদ, শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত, ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার নাজমুল ইসলামসহ ১০ জন। এর মধ্যে ৫ জন আটক, ২ জন জামিনে ও ৩ জন পলাতক। ২০২০ সালের ৭ জুন গ্রেপ্তার হন সাবেক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত রুবেল ও বরকত। এর আগে ১৬ মে ফরিদপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে।
খন্দকার মোহতেশাম তিনি ঠেঙাড়ে বাহিনী দিয়ে সবকিছু দখল করেন এবং দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বিতাড়িত করেন। তাঁর নির্দেশেই সেখানে বরকত-রুবেল জুটি সব অপকর্ম করেছেন। অন্যদিকে মন্ত্রীর এপিএসের ভয়ে পুরো এলাকার মানুষ ছিল সন্ত্রস্ত। ফরিদপুরের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। কেউ টুঁ শব্দ করার সাহস পেত না। তিনি নামে বেনামে শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। ঢাকা ও ফরিদপুরে অন্তত ১০টি বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। তাঁদের থাবা থেকে সংখ্যালঘুরাও রেহাই পাননি। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অরুণ গুহের বাড়ির প্রতি সাবেক মন্ত্রীর নজর পড়ে এবং তিনি বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে সেই বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। এক পর্যায়ে অরুণ গুহ দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে ছিলেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ হয়নি।
একটি জেলা সদরের আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলা। কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন। বাংলাদেশে ৬৪টি জেলা আছে। সেই হিসাবে আওয়ামী লীগের নেতারা-বৈধ অবৈধ পথে কী বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা অনুমান করা কঠিন নয়। আওয়ামী লীগ আমলে কত হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, তার হিসাব নেই। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থেই কানাডা, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, বেগমপাড়া গড়ে উঠেছে।
এ সরকারের আমলে অর্থ পাচারের বিষয়টি বেশি জানাজানি হয় ক্যাসিনো-কাণ্ডে। আর কেউ ধরা পড়লেই আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁর অতীত নিয়ে টানাটানি শুরু করেন। আগে কে কোন দল করতেন, সেই তথ্য প্রকাশ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বলা হয়, ঠিকাদার জি কে শামীমের সঙ্গে বিএনপির মন্ত্রীদের দহরম-মহরম ছিল। সেই জিকে শামীম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গণপূর্ত বিভাগের এক-তৃতীয়াংশ কাজ কী করে ভাগিয়ে নিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। জি কে শামীম বহিরাগত। কিন্তু ইসমাইল হোসেন সম্রাট কিংবা গেন্ডারিয়ায় যে দুই ভাই নিজদের বাড়িতেই টাকার ব্যাংক বানিয়েছিলেন তাঁরা তো আওয়ামী লীগের ‘ভূমিপুত্র’।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলে ‘কাউয়া’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ ঢুকেছে বলে বহুবার আক্ষেপ করেছিলেন। ফরিদপুরের ঘটনায় কী বলবেন তিনি? সেখানে আওয়ামী লীগের খন্দকাররাজ কায়েম করা হয়েছিল। এ রকম জেলায় জেলায় যে আরও কত রাজ কায়েম হয়েছে, আরও কত মোহতেশাম তৈরি হয়েছে, সেই খবর কি দলের সাধারণ সম্পাদক রাখেন? তিনি প্রতিদিন বিএনপিকে নসিহত করেন। ভালো কথা। কোনো রাজনৈতিক দল অন্যায় করলে তার প্রতিপক্ষ সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতা-কর্মী যে শরীর থেকে চোখটাই তুলে ফেলেছেন, সেই খবর তার জানা নেই? উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ নেই। ক্যাসিনো-কাণ্ডে দলের নিচের ও মাঝারি পর্যায়ের নেতারা ধরা পড়েছেন। রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছেন।
ফরিদপুরের কথাই যদি বলি, মোহতেশাম, রুবেল কিংবা বরকতের শক্তির উৎস কী ছিল? একজন এপিএসের ভয়ে পুরো শহরের মানুষ শঙ্কিত ছিল। ফরিদপুরে বরাবর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল। সেই সম্প্রীতি কে নষ্ট করেছেন, তাও খুঁজে বের করা দরকার। মোহতেশাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর ফরিদপুরে আনন্দ মিছিল হয়েছে। মানুষ মিষ্টি খেয়েছে। প্রথম যখন রুবেল-বরকত গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তখনো সেখানে আনন্দ মিছিল হয়েছিল।
গত বুধবার ফরিদপুরের কয়েকজন সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা জানান, মোহতেশামের গ্রেপ্তারে সর্বস্তরের মানুষ খুশি। সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন মোহতেশামের ঘটনাকে তাঁর নিজস্ব ব্যাপার বলে দায় এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু ফরিদপুরের মানুষ মনে করেন, ফরিদপুরে যত অঘটন হয়েছে, তার পেছনে খন্দকার ভ্রাতৃদ্বয়ের অবদানই বেশি। তাই ছোট ভাইয়ের দায় কোনোভাবে বড় ভাই এড়াতে পারেন না। ছাগল নাচে খুঁটির জোরে এবং ফরিদপুরে সেই খুঁটি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী।
ফরিদপুরের মানুষ একের পর এক বিস্ময়কর ঘটনার মুখোমুখি। প্রথম বিস্ময় মহাপ্রতাপশালী রুবেল-বরকতের গ্রেপ্তার। দ্বিতীয় বিস্ময় মোহতেশামের গ্রেপ্তার। সামনে হয়তো আরও কোনো বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে।