বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচারে ব্যর্থতাই এখন বাস্তবতা

0

বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচারে ব্যর্থতাই এখন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। সাংবাদিক সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সংস্থাটির পাঁচজন বিশেষজ্ঞ (র‌্যাপোর্টিয়ার) বিবৃতি দেন।

বিবৃতিতে সাগর-রুনি হত্যার অনুসন্ধান শেষ ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে ব্যর্থতায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে ব্যাপক ও ভয়ানক বলে মন্তব্য করা হয় বিবৃতিতে।

২০১২ সালে তাঁদের বাসা থেকে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁদের শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। এ সময় তাঁদের পাঁচ বছরের ছেলে মেঘ বাসায় ছিল।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বিবৃতিতে ২০১৭ সালে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের তৎকালীন মেয়রের গুলিতে নিহত সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল ও কারাগারে মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদের কথাও উল্লেখ করেন। উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সরকারের কাছ থেকে কোনো জবাব পাননি বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।

বিবৃতিদাতা জাতিসংঘের পাঁচ র‌্যাপোর্টিয়ার হলেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার র‌্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান, মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ম্যারি লয়োলার, শান্তিপূর্ণ জমায়েতের অধিকারবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ক্লিমেন্ট এন. ভোল,

নির্যাতন ও অমানবিক আচরণবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার নিলস মেলজার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার মরিস টিডবল-বিঞ্জ।

যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ‘দুজন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের পর এক দশক পার হলেও কোনো বিচার হয়নি এবং বাংলাদেশে এক ভয়ানক ও ব্যাপক দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজ করছে। ’

জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তর থেকে গতকাল পাঁচ বিশেষজ্ঞের বিবৃতিসংবলিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে দুর্নীতির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে কার্যক্রম ও তা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণের কারণেই এই দম্পতি (সাগর-রুনি) লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। ’

২০১২ সালে উচ্চ আদালত র‌্যাবকে সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেন। গত বছরের ২৪ নভেম্বর আদালত ৮৪ বারের (সর্বশেষ হিসাবে ৮৫ বার) মতো র‌্যাবকে তাদের তদন্তের ফলাফল জমা দিতে বলেন। র‌্যাব গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, তারা সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে তদন্ত করছে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বিবৃতিতে বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার না হলে তা গণমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে চুপ করানোর উদ্দেশ্যে দোষীদের উৎসাহ দেয় এবং আরো আঘাত, ভীতি ও হত্যাকে ত্বরান্বিত করে; এবং আমরা বাংলাদেশে সেই গভীর উদ্বেগের নিদর্শন দেখতে পাই। ’

জাতিসংঘ জানায়, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে কমপক্ষে ১৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা বিচারে আটক, আক্রমণ, অপহরণ, অনলাইন ও অফলাইনে ভীতি প্রদর্শন এবং আইনি হয়রানির শিকার হওয়ার অসংখ্য প্রতিবেদন পেয়েছে। ঘটনাগুলোর তদন্ত বা বিচার হয়নি বললেই চলে।

জাতিসংঘ বলেছে, সংস্থাটির বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ সরকারের গোচরে আনা অভিযোগগুলোর বিষয়েও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো জবাব পাননি। ২০১২ সালে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের পর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের পাঠানো চিঠির কোনো জবাব সরকারের কাছ থেকে কখনো পাওয়া যায়নি।

জাতিসংঘ বলেছে, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহজাদপুরের তৎকালীন মেয়রের গুলিতে নিহত সাংবাদিক ও মানবাধিকারর্মী আব্দুল হাকিম শিমুলের মামলার বিচারকাজ বারবার পেছানো উদ্বেগজনক। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের আওতায় ওই মামলার সব আসামি বর্তমানে জামিনে আছেন।

বিজ্ঞপ্তিতে ৯ মাসের প্রাক-বিচারিক আটকাবস্থায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেলখানায় মৃত্যুবরণকারী লেখক মুশতাক আহমেদের কথাও উল্লেখ করা হয়। লেখক মুশতাক মহামারি মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনা করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

জাতিসংঘ বলেছে, পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হওয়া এবং অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে নিতে তিন ঘণ্টা বিলম্ব হওয়ার পারিবারিক উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ব্যাপারে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করেনি। তার পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় গঠিত অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত কমিটি পরিবারের দাবির বিষয়ে তদন্ত না করেই তাঁর মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে সাব্যস্ত করে। উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সরকারের কাছ থেকে কোনো জবাব পাননি।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আক্রমণ, ভীতি ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সহজাত ঝুঁকি থেকে সাংবাদিকতা মুক্ত থাকা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করতে না পারার সরকারি ব্যর্থতার কারণে সেটাই বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীর বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ’

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি এবং বাংলাদেশের অন্যান্য সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সম্পূর্ণ, দ্রুত, বিশদ, স্বাধীন ও কার্যকর তদন্ত পরিচালনা ও তা সম্পন্ন করা এবং দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। ’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com