অনির্বাচিত আ.লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে দেশের ১৫০০ মানুষকে গুম করেছে: রিজভী

0

ক্ষমতাসীন নিশিরাতের সরকার বিনাভোটে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে গুম করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।

তিনি বলেছেন, মানুষ গুম দুনিয়ার সবচেয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর, অমানবিক, পাশবিক এবং চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ। কারণ, গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজন এবং পরিবারের সদসদেরকে আমৃত্যু অসহনীয় মর্মন্তুদ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয়। কারণ, তারা জানে না তাদের গুম হওয়া স্বজন বেঁচে আছে নাকি নেই। যার ভয়ংকর উদাহরণ বিএনপির সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলী, সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু, বিএনপি নেতা হুমায়ুন পারভেজ ও ঢাকার নির্বাচিত কমিশনার চৌধুরী আলমসহ বিরোধী দলীয় সহস্রাধিক নেতা। বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আজও তাদের পরিবার জানে না তারা কোথায় আছে কিভাবে আছে? প্রতি মুহূর্ত পার হচ্ছে গুম হওয়া স্বজনদের অধীর প্রতীক্ষায়। স্বজনদের ফিরে পাওয়ার জন্য আর্তনাদ করছেন। দেশে-বিদেশের মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোর হিসেব মতে, গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে গুম করেছে।

বুধবার (৯ ফেব্রয়ারি) দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

রিজভী বলেন, অসংখ্য মানুষ খুন, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে অব্যাহত গুম খুনের ব্যাপারে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন সময়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। এমনকি গুম বিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ, বাংলাদেশে গুম অপহরণের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখতে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরের অনুমতি চেয়ে বেশ কয়েকবার আবেদন জানিয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ এপ্রিলে বাংলাদেশকে সফরের অনুরোধ জানিয়েছে কিন্তু ওয়ার্কিং গ্রুপে কোনো আবেদনেই বাংলাদেশ সাড়া দেয়নি।

দেশে গুম-অপহরণ বন্ধে বিএনপি বারবার সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে আসছিলো এমন দাবি করে দলটির মুখপাত্র বলেন, কিন্তু ক্ষমতার লোভে নিশিরাতের সরকার গুম, খুন, অপহরণ বন্ধে দেশের কিংবা বিদেশের  কারো কোন কথায় গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ক্ষমতা লিপ্সায় র‌্যাব-পুলিশকে গুম-খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়ে ফেলেছে।

‘এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার থেকে শুরু হয়েছে গুম বিষয়ক জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ১২৬তম বৈঠক। বৈঠক চলবে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় বাংলাদেশসহ বিশ্বের হাতেগোনা আরো কয়েকটি দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপকর্ম গুমের অভিযোগ পর্যালোচনা। যেহেতু বর্তমান সরকার গুমের সাথে জড়িত, সেই কারণে তারা গুম নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপিত অভিযোগ গায়ে মাখে না। কিন্তু কথায় বলে, চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। খুনিদের বিদেশে পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে আসতে থাকায় একইসঙ্গে দেশে জনরোষের ভয়ে নিশিরাতের সরকারের মন্ত্রীরা উদ্ভট কথাবার্তা বকতে শুরু করেছে।’

তিনি বলেন, ৫ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জাতিসংঘ নয়, জাতিসংঘের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের একটি তালিকা দিয়েছিল। পরে দেখা গেল, ভূমধ্যসাগরে অনেক লোকের সলিল সমাধি হয়েছে।’ একই দিনে অবৈধ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা সব সময় বলি, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। যেখানেই গুম হচ্ছে, সেখানেই আমরা কিছুদিন পরেই তাকে পাচ্ছি। নানা কারণে আত্মগোপন করে থাকে, সেগুলোকে গুম বলে চালিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশে কেউ গুম হয় না’।

রিজভী বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যে গুমের সঙ্গে জড়িত, সেই সব ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। ভিডিও ফুটেজ আছে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন থেকেও গুমের ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থা তদন্ত করে জাতিসংঘে গুমের প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গুমের শিকার ৮৬ ব্যক্তির ছবি প্রকাশ করে তাদের বিষয়ে “যেখানে কোনো আলো পৌঁছায় না: বাংলাদেশে গুমের এক দশক” শিরোনামে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দাবিতে তারা বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা অসংখ্যবার আবেদন করলেও গুম হওয়া ব্যক্তিদের তাদের প্রিয়জনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি।

‘এর আগে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপেয়ারেন্সেস কর্তৃক বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করা হয় এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ সদস্যরা সরকারের নির্দেশে দফায় দফায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার নামে হয়রানি করে এবং পুলিশ সদস্যরা গুমের শিকার ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন এবং পরিবার তথ্য গোপন করেছে এই মর্মে কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে।গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে দুই মন্ত্রীর এই ধরনের উপহাস খুবই নিষ্ঠুর, অশালীন ও বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।’

তিনি বলেন, বিরোধী শক্তিকে দমন করতে অবৈধ ক্ষমতাসীন সরকারের গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, নিপীড়ণের কথা আজকে বিশ্ব দরবারে প্রমাণিত। তাই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সরকারের মন্ত্রীরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এসব অবিবেচনা প্রসূত, ঘৃণ্য বক্তব্য দিচ্ছে। নিশিরাতের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মন্ত্রীদের  মতো গুম-খুন নিয়ে অবাস্তব, আজগুবি ও নিষ্ঠুর পরিহাসমুলক মন্তব্য করে আসছেন। আপনাদের স্মরণ আছে, ২০১৫ সালে ২০ দলীয় জোটের মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্বরত তৎকালীন বিএনপি’র যুগ্ম-মহাসচিব ও বর্তমানে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী জননেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে রাতের অন্ধকারে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি বাসা থেকে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে চোখ বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে গুম করার পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘সালাহউদ্দিনকে খালেদা জিয়া ময়লার বস্তায় ভরে পাচার করে দিয়েছে’। অধিকাংশ বড় বড় গুম-খুনের পর সরকারের বক্তব্য চরম বিদ্রুপাত্মক।

বিএনপির এই নেতা বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ছাতার নীচে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতেই গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। গোটা জাতিকে গুম-খুনের নিষ্ঠুর নির্যাতনে ‘খাঁচাবন্দী’ করে রেখেছে। প্রশ্ন হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি মনে করেন, ‘গুমের সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত নয়’ তাহলে তাকেই জবাব দিতে হবে গুমের সঙ্গে কারা জড়িত? কে বা কারা একের পর এক মানুষ গুম খুন করছে? গুমের তালিকায় থাকা কোন কোন ব্যক্তির ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে? আমাদের দলের নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ শত মানুষকে ক্ষমতাসীন অবৈধ সরকার গুম করেছে। তাদের কার কার ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হয়েছে এর জবাব বিনাভোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিতে হবে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট যে, গুম হওয়া বা তার ভাষায় ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা তার কাছে আছে। অবিলম্বে সেই তালিকা প্রকাশ করা হোক।

তিনি বলেন, গুম-খুন-অপহরণ করে আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে ধরা পড়ে কয়েকদিন আগে এই নিশিরাতের সরকার ঘোষণা দিয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নাকি ‘মানবাধিকার সেল’ গঠন করা হবে। গুমের তালিকায় থাকা কোন কোন ব্যক্তির ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে এমন কথা বলে আবুল মোমেনা সাহেব ইতোমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘মানবাধিকার সেল’ এর রিপোর্ট কি হবে।

ওয়াসার পানির দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, গত সোমবার ওয়াসার পানির দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছে। সোমবার প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ বোর্ডসভায় ৪০ শতাংশ পানির দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। বর্তমানে প্রতি ১০০০ লিটার পানির আবাসিক গ্রাহকরা ঢাকা ওয়াসাকে দেয় ১৫.১৮ টাকা। আর বানিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে এই দাম ৪২ টাকা। গত বছর ২৫ মে ওয়াসা পানির দাম ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট পানির দাম এখন ১৪.৪৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৫.১৮ টাকা হলো। আর বানিজ্যিক সংযোগে প্রতি ইউনিট পানির দাম ৪০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৪২ টাকা করা হলো। ২০২০ সালের এপ্রিলেও পানির দাম বৃদ্ধি করেছিল ওয়াসা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, ২০১৮ সালের জুলাইতে, ২০১৭ সালের আগষ্টেও পানির দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ওয়াসার এমডি পানির দাম এখন যা আছে সেটা থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পানি হচ্ছে জীবনের অপর নাম। অবৈধ সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ হরিলুট করার পর এখন মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় যে পানি সেটির দাম বৃদ্ধি করছে। দেশকে দরিদ্র, দুর্নীতিগ্রস্ত ও তীব্র অসাম্যের মধ্যে নিক্ষেপ করে এরা জনগণকে ভাতে ও পানিতে মারার সকল বন্দোবস্ত সম্পন্ন করছে। আমি ওয়াসা কর্তৃক পানির দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে এ ধরণের অমানবিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহবান জানাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, যুগ্ম-মহাসচিব হাবিবুন নবী খান সোহেল, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম, মৎসজীবি দলের সদস্য সচিব আব্দুর রহিম, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা জাহিদুল কবির, মোর্শেদ আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com