বর্তমানে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ শেষ হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার আগেই নতুন ইসি নিয়োগ দিতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। গত দুইবারের মতো প্রায় সব রাজনৈতিক দলই নতুন ইসি গঠনের জন্য সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছে। কয়েকটি দল নতুন সার্চ কমিটির জন্য নাম প্রস্তাব করলেও কেউ কেউ বলেছে এ প্রক্রিয়ার কোনো দরকার নেই। আর নতুন ইসি গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি এবারো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের আয়োজন করেন। অবশ্য বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল সংলাপে অংশ নেয়নি। এরই মধ্যে সংলাপের শেষ দিনে গত সোমবার রাষ্ট্রপতির নির্দেশে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের সুযোগ রেখেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সম্পর্কিত খসড়া আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিরোধী দলের নেতারা এই আইনকে ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ বলে অভিহিত করছেন, যা অতীতের দুইটি সার্চ কমিটি ও ইসিকে বৈধতা দেয়ার জন্য আইনি কাঠামোতে আনা এবং জনগণকে ধোঁকা দেয়ার নতুন কৌশল। এই আইনে সঙ্কট সমাধানের পরিবর্তে আরো ঘণীভূত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে তাদের মত।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং এ বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন। কিন্তু ওই আইন গত ৫০ বছরেও হয়নি। গত এক দশকে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমান ২০১২ সালে এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ২০১৭ সালে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সর্বশেষ দুই ইসি নিয়োগ দেন।
নতুন আইন প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইসি গঠনে আইন করা নিয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা আছে। সে জন্য উদ্যোগটি ইতিবাচক। তবে বর্তমান ইসির মেয়াদের শেষ মুহূর্তে হঠাৎ আইন করার উদ্যোগ প্রশ্ন তৈরি করে। আইনের খসড়ায় সংসদকে পাশ কাটানো এবং সংসদ সদস্যদেরকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সার্চ কমিটিতে সেইসব পুরনো পদাধিকারী ব্যক্তিদেরকেই রাখা হয়েছে। অতীতে দুটো সার্চ কমিটিরও প্রধান ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি। এবারো সে রকমই হতে পারে। অতীতে এ ধরনের সার্চ কমিটি করে আমরা নুরুল হুদা ও রকিব উদ্দিন কমিশন পেয়েছি। বর্তমানেও সে ধরনের কমিশনই পাবো। তার থেকে ভালো কিছু হবে কি না সেই প্রশ্ন করা অযৌক্তিক নয়।
তিনি বলেন, যে আইন করা হয়েছে তা মূলত অতীতের দু’টি সার্চ কমিটি এবং দু’টি ইসিকে বৈধতা দেয়া, সেটাকেই আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা। এটার তো কোনো দরকার ছিল না। রাষ্ট্রপতি অতীতে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে করেছেন, এবারো করতে পারতেন। সার্চ কমিটির জন্য তো আইনের দরকার নেই। দরকার নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য। কারণ সংবিধানের ১৫৮ নং অনুচ্ছেদে সেটা বলা আছে। আমাদের আশঙ্কা, ইসি নিয়োগ সম্পর্কিত সেই পুরনো প্রক্রিয়া বিরোধের সমাধানের পরিবর্তে আবারো বিষফলেরই পুনরাবৃত্তি হবে। হুদা কমিশন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ভোটাধিকার ধ্বংস করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেউই দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। তাদের দায়বদ্ধ করা দরকার। এ জন্য আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে খোলা চিঠিও দিয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন হওয়া উচিত। অথচ এখন তাদেরকেই বৈধতা দেয়া হচ্ছে। ইসি গঠনের জন্য আইন করে বৈধতা দেয়া বিশ্বের কোনো দেশে নেই। অর্থাৎ ইসি নিয়ে পুরনো পথেই হাঁটছে সরকার। সবচেয়ে বড় কথা হলো সঠিক ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশনে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে ‘যেই লাউ সেই কদু’ হবে। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী যার নাম সুপারিশ করবেন তাকেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে বাধ্য হবেন। তার একচুল নড়ারও কোনো সুযোগ নেই। নতুন আইনটি সমস্যা সমাধানের চেয়ে নতুন সঙ্কট তৈরি করে কি না সেটাই প্রশ্ন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা নাই। তার সংলাপ অর্থহীন এটা ইতিহাস প্রমাণ করে। এই সংলাপে কিছুই অর্জিত হয়নি বরং পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অনুগত ও অপদার্থ ইসি গঠনের চলমান প্রক্রিয়াকে দলীয় স্বার্থে আইনি রূপ দেয়ার সরকারি অপপ্রয়াসের ফল হবে ‘যেই লাউ, সেই কদু’। এবার সম্ভবত হতে যাচ্ছে একটি পচা কদু। এতদিন ধরে যেটা প্রশাসনিক কায়দায় হয়েছে এখন সেটা আইনি কায়দায় হবে। পচা কদু এ জন্য বলছি যে, খসড়া আইনে প্রস্তাব করা হয়েছে সরকারি চাকরির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ এটার সদস্য হতে পারবেন না। অর্থাৎ সিভিল সোসাইটির কেউ অথবা কোনো শিক্ষাবিদ, কোনো আইনজ্ঞ তারা কেউ সদস্য হতে পারবেন না। দুনিয়ার কোথায় এ রকম বিধিনিষেধ আছে?
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এসব কর্মকাণ্ড সরকারের ফোর-টুয়েন্টি বিজনেস মনে করি। ওরা আইন ছাড়া যা করতে চাইছে তাই করবে এখন। এখন আইনের একটা কাভারেজ দিলো। এটা কোনো কথা হলো- সেখানে কোনো সিভিল সোসাইটির লোক নেবে না। তারা সব সরকারি আমলাদের নেবে। আর ওরা সার্চ কমিটিতে যাদের ইচ্ছা তাদের দেবে। তিনজন তাদের দিবে দু’জন আমলা নিবে, সব তাদের লোক। জিনিসটা যদি করতে চায় তবে সঠিকভাবে করুক। দেশটা গোল্লায় চলে গেছে। এটা করে তারা আরেকটা অপরাধ করল। ইসি গঠনে আইনি কাভারেজ দিয়ে তাদের বেআইনি কাজকে জায়েজ করা হচ্ছে, এটা আরেকটা অপরাধ। তারা তো সব কিছুতেই নাটক করেই যাচ্ছে। যেই ইসি নিয়ে এত কথাবার্তা হচ্ছে সেটা নিয়ে ফের নাটক শুরু করল। জনগণকে দেখাচ্ছে যে, আমরা আইন তো করেছি!
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ইসি গঠন নিয়ে আইনের অর্থ হচ্ছে পুরনো মদ নতুন বোতলে দেয়া। ইসি গঠনে যে আইন করা হয়েছে সেখানে সার্চ কমিটি হবে সরকারের লোক দ্বারাই। রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপের নামে নাটক হয়েছে। সেটা তো সংলাপ ছিল না। যদিও অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সংলাপে যায়নি। সবাই চাচ্ছে আইনের মাধ্যমে একটি ইসি গঠন করতে। সে জন্যই তারা এখন আইন প্রণয়ন করেছে। সেই আলোকে একটা সার্চ কমিটি হবে। যারা ইসি নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবেন। সেই মোতাবেক ইসি নিযুক্ত হবে। তাহলে ঘটনা তো একই থাকল। গণতান্ত্রিক দেশ যেমন শ্রীলঙ্কা ও ভারতে সংসদে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধির মতামত নিয়ে ইসি গঠিত হয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু আমাদের এখানে তো জনগণের সরকারই নাই, আর কি হবে? এই আইন কিছু না। আসলে আইন চেয়েছেন আইন দিলাম, যার কোনো অর্থ নেই। এই আইন মানুষকে ধোঁকা দেয়ার একটা অভিপ্রায়। এক কথায় মূল্যহীন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এই আইন সঙ্কট সমাধান করবে না। কারণ সঙ্কটটা হলো রাজনৈতিক। এ ব্যাপারে আমরা বলেছিলাম সরকারকেও রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া দরকার; বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করা যে, নির্বাচন কমিশন ও আইনটা কিভাবে হবে? নির্বাচন কমিশন কিভাবে দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য লোকদের দিয়ে হবে? সঙ্কট উত্তরণে সবারই বোঝাপড়া দরকার। কিন্তু সরকার তার পুরনো পথেই হাঁটছে। রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও উনার পদের যে, সম্মান ও নৈতিক ক্ষমতা আছে সরকারি দলকে উনি রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলতে পারেন। সরকারি দল সোমবার রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন; কিন্তু রাষ্ট্রপতি তাদেরকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেননি। যদিও বড় একটা সুযোগ ছিল তার পক্ষে। আসলে রাষ্ট্রপতির ঘাড়ে বন্দুক রেখে সঙ্কটের সমাধান হবে না। নতুন আইন সার্চ কমিটিকে তাদের মতো করে একটা আইনি রূপ দেয়ার তৎপরতা, যা গ্রহণযোগ্য হবে না। বাস্তবে সঙ্কট যেখানে ছিল সেখানেই থাকছে; যা আরো ঘণীভূত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।