ভারতীয় সীমান্তবাসীর জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে বিএসএফ
ভারতের দিকে সীমান্তবাসী মানুষের চলাফেরা – চাষাবাদ, বিয়ে-শাদি, এমনকি ঘর থেকে বাথরুমে যাওয়ার ওপরেও নজরদারি করে বিএসএফ। বিষয়টা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যও যে ভারতীয় সীমান্তবাসীর জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে বিএসএফ।
এ প্রতিবেদনের শিরোনাম এমন হতে পারত যে ‘বিএসএফের কাজের এলাকা বৃদ্ধি নিয়ে কী ভাবছেন সীমান্তের মানুষ’, অথবা এ জাতীয় কিছু। কারণ, এ লেখাটা ওই বিষয় নিয়েই হওয়ার কথা ছিল।
বিএসএফের কাজের এখতিয়ার বৃদ্ধি নিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের প্রতিক্রিয়া কী, তা জানতেই কয়েক দিন আগে গিয়েছিলাম উত্তর চব্বিশ পরগণার সীমান্ত ঘেঁষা কিছু গ্রামে।
তবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই অঞ্চলে কাটিয়ে, মানুষের কথা শুনে আর কিছু কিছু ঘটনা দেখে এ লেখার বিষয়-ভাবনা যেমন বদলাতে হল, তেমনই এটা ছাড়া আর কোনো শিরোনামও মাথায় এল না।
কারণ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়ার পাশে থাকা বিভিন্ন নারী-পুরুষ বলছিলেন কিভাবে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই বিএসএফ সদস্যদের নজরদারিতে থাকতে হয় তাদের।
প্রতিটা কাজের জন্য দরকার বিএসএফের অনুমতি
সকালে উঠে মাঠে গরু নিয়ে যেতে গেলে অনুমতি, বাজার থেকে জামা বা আনাজ কিনে আনতে গেলে তল্লাশি, প্রসূতি নারীর পেট কেন ফুলে আছে – ওই প্রশ্নের জবাব এসবই মেনে নিতে হয়েছে ভারতীয় সীমান্তবাসীদের।
দিনের শুরুটা করেছিলাম স্বরূপনগর এলাকার হাকিমপুর এলাকা থেকে।
তারালি গ্রামের বাসিন্দা মেহেরুন্নিসা গাজির সাথে কথা বলার সময়েই এক বিএসএফ সদস্য কাঁধে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে তার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে পিছনের দিকে চলে গেলেন চোখের সামনেই। বাড়ির কারো অনুমতি নেয়াও হলো না।
মেহেরুন্নিসা গাজি বলেন, ‘দেখলেন তো, আপনার সামনে দিয়েই কিভাবে বাড়ির উঠোন দিয়ে চলে গেল। বাড়িতে মেয়ে ও বউরা আছে, জিজ্ঞাসা করার কোনো ব্যাপারই নেই এদের।’
তার সাথে কথা বলে যে দিনের শুরু, তা শেষ হয়েছিল বেশ রাতে, ওই হাকিমপুর থেকে অনেকটা দূরে। পেট্রাপোল সীমান্তের কাছাকাছি কালিয়ানি নামের একটা গ্রামে। গ্রামের বাসিন্দা শর্মিলা সরকার আর মেহেরুন্নিসা গাজির কথার মধ্যে বিশেষ ফারাক পেলাম না।
বাথরুম যেতে গেলও টর্চ মারে
শর্মিলা সরকার বলেন, ‘এদের ডিউটি তো করার কথা বর্ডারে। কিন্তু এরা নজর রাখে আমাদের বাড়ির ওপর। বাসন মাজছি, বা কাপড় কাঁচছি তখন বিএসএফ সদস্যরা গান গাইতে গাইতে চলে গেল। বাড়ির পুরুষরা কিছু বললে গালি দিল। আবার রাতে বাথরুমে যাব, টর্চ মেরে দেখে যে কে যাচ্ছে। রাতে ঘুমিয়েও নিস্তার নেই, বেড়ার গায়ে বাড়ি দেবে। সবসময় আমাদের দেখছে তারা, কিন্তু রাস্তায় বেরলেই জিজ্ঞাসা করবে ও বৌদি কোথা থেকে এসেছেন, বাংলাদেশ থেকে নাকি।’
শুধু দোকান বা বাজার থেকে ফেরার পথে নয়, বিয়ে করতেও বিএসএফের অনুমতি লাগে সীমান্ত অঞ্চলে।
হাকিমপুর গ্রামেরই গৃহবধূ জসমিনা বিবির কথায়, ‘বাড়িতে বিয়ে-শাদি থাকলে আগে থেকেই ক্যাম্পে জানাতে হয়। আর এখানে এত চেকিং, এত চেকিং যে বাইরের লোক এসব জায়গায় বিয়ে দিতেই চায় না। তাই গ্রামের মধ্যেই বিয়ে শাদি সারতে হয়।’
ভারতীয় পরিচয়পত্র সবসময় দেখাতে হয়
ভারতীয় ভূখণ্ডের সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাদের ভারতীয় পরিচয়পত্র। যে কোনো জায়গায় ওই পরিচয়পত্র দেখতে চাইতে পারেন বিএসএফ সদস্যরা।
হাকিমপুর গ্রামে মেহেরুন্নিসা গাজির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিলাম, দূরে এক বিএসএফ প্রহরী কয়েকজন নারী-পুরুষের কাছে দাঁড়িয়ে কিছু জানতে চাইছিলেন।
তারা যখন আমার কাছাকাছি এলেন তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি জানতে চাইছিল আপনাদের কাছে?
জবাবে রেণু গাজি আর রুহুল আমিন সর্দার বলছিলেন, আই কার্ড দেখতে চায়। সবসময়ে কাছে রাখতে হয় এটা। ব্যাগ থেকে বার করে ভোটার পরিচয়পত্র দেখালেন আমাকেও।
রেণু গাজি বলেন, বিএসএফ সদস্যরা বলছিল যে ব্যাগে কী আছে দেখাও। একবার ওঠ, একবার বসো, ব্যাগে বাড়ি মারো।
রুহুল আমিন সর্দার বলছিলেন, ‘রাস্তায় বেরনই কঠিন। হয়তো বাজার থেকে আসছি, একটু সন্ধ্যা হয়েছে, বলবে ব্যাগে করে কী নিয়ে যাচ্ছি – ফেন্সি আছে নাকি, বিড়ি আছে নাকি, লাইনম্যানি করছিস না কি। বলেই ব্যাগে একটা লাঠির বাড়ি দেবে।’
এ এলাকায় ফেন্সি মানে নিষিদ্ধ ফেন্সিডিল আর লাইনম্যানি শব্দের অর্থ পাচারকারী।
নারীদের ব্যাগ তল্লাশি করে পুরুষ সীমান্তরক্ষী
রেণু গাজিকে প্রশ্ন করেছিলাম, যিনি আপনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি তো নারী কনস্টেবল নন, পুরুষ! নারী কনস্টেবল থাকে না?
রেণু গাজির সাথে থাকা আরো কয়েকজন নারী বলে উঠলেন, “না না, মহিলা কনস্টেবল নেই।”
সব জায়গায় হয়তো নারী প্রহরী থাকে না, কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় বিএসএফের নারী কনস্টেবলদের সন্ধ্যার অন্ধকারে একা একা দাঁড়িয়ে ডিউটি করতেও দেখেছি।
আর বাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান, অতিরিক্ত মহানির্দেশক ওয়াই বি খুরানিয়ার কথায়, পুরো ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে হাজার চারেক নারী প্রহরী আছেন।
ওয়াই বি খুরানিয়া বলেন, ‘পূর্ব কমান্ডে প্রায় চার হাজার নারী সীমান্ত প্রহরী আছেন। তাদের মূলত ওইসব গেটে রাখা হয়, যেখান দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় মানুষ যান, সেখানে।’
ঘটনাচক্রে, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের দৈর্ঘ্যও ৪১৪২.২৭ কিলোমিটার।
একজন পুরুষ কনস্টেবল যদি বিমানবন্দর বা দেশের অন্য কোথাও কোনো নারীর ব্যাগ পরীক্ষা করতে চাইতেন তাহলে তা নিয়ে বড়সড় বিতর্ক বেঁধে যেত। কিন্তু, এটা তো সীমান্ত এলাকা।
ভুয়া মামলার ভয়
মেহেরুন্নিসা গাজি বলেন, সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে থাকতে হয় আমাদের। আমাকে আর আমার স্বামীকে কতবার ভয় দেখিয়েছে যে নারী কেস, গরুর কেস বা ফেন্সি কেস দিয়ে ফাঁসিয়ে দেবে।
তার যে ভয়টা আছে, সেটা সত্যি হয়ে নেমে এসেছিল দহরকান্দার বাসিন্দা তসলিমা বেগম সর্দারের জীবনে। সর্দার প্রায় ২৫ মাস মাদক পাচারের অভিযোগে জেলে থাকার পরে সম্প্রতি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
২০১৯ সালের ১৯ মে তারিখ সকালে কাজের জায়গায় যাচ্ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী সর্দার। সাথে ছিলেন তার মেয়েও।
ফেন্সিডিল সাজিয়ে ছবি তুলতে চাইছিল
তসলিমা বেগম সর্দার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ’আমাকে আর মেয়েকে বিএসএফ দাঁড় করিয়ে বলল ব্যাগ চেক করব। আমরা কোনো আপত্তি করিনি – দেখুক চেক করে। তখন তারা বলে এখানে না, ক্যাম্পে গিয়ে চেক হবে। নিয়ে গেল ক্যাম্পে। আমাদের যেখানে বসিয়ে রেখেছিল, হঠাৎই দেখি সেখানে ফেন্সিডিল সাজাচ্ছে টেবিলে। বলা হলো ছবি তুলব।’ তিনি সাথে সাথে আপত্তি করেন ছবি তুলতে।
তার কথায়, ‘আমি বলেছিলাম ওই জিনিস আমার সাথে ছিল না, কিছুতেই ছবি তুলব না ওসব জিনিসের সাথে। মেরে লাশ করে ফেললেও ছবি তোলাতে পারবে না তোমরা। খুব মারধর করল আমাদের। তারপরে থানায় নিয়ে গেল। বড়বাবু, মেজবাবু ছিলেন। তখন একটু সাহস এসেছে আমাদের, যে থানায় এনে তো আর মারতে পারবে না বিএসএফ। সব কথা খুলে বলেছিলাম যে মিথ্যা কেসে ফাঁসানো হচ্ছে আমাদের।”
কিন্তু ততক্ষণে মামলা রুজু হয়েহয়ে গেছে। জেল হাজতে যেতে হয়েছিল মা মেয়েকে।
এসব হেনস্থার অভিযোগ সম্প্রতি উঠে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাতেও।
বিএসএফের এক্তিয়ার বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আনা এক সরকারি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময়ে একাধিক বিধায়ক সীমান্তবাসীর নিয়মিত হেনস্থার কথা তুলে ধরেন।
প্রতিটা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয় : বিএসএফ
ওই প্রসঙ্গে বিএসএফের পূর্ব কমান্ডের প্রধান ওয়াই বি খুরানিয়া বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটা অভিযোগ খুবই গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখি। প্রতিটা অভিযোগের ক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। ওই প্রক্রিয়া কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। তবে এখানে একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার। এখানে বেশ কিছু কায়েমি স্বার্থ কাজ করে। তারা যেসব আন্তঃ সীমান্ত বেআইনি কাজকর্ম করে, তা চালিয়ে যাওয়ার জন্যই নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় অনেক সময়। এমন অভিযোগ মাঝে মাঝেই পাই আমরা। তবে অভিযোগ পেলেই তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিই।
আইন তো আছে, কিন্তু যেখানে সব সময়ে মানুষকে ভয়ে থাকতে হয় যে ভুয়া অভিযোগে বিএসএফ ফাঁসিয়ে দেবে। সেখানে কি কারো সাহস হয় পানিতে থেকে কুমিরের সাথে বিবাদ করার? আর এ কারণেই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর অনেকে জমি বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। যেমন একজন হাকিমপুর গ্রামের এক্রামুল মোল্লা।
আবার কালিয়ানি গ্রামের কৃষকদের কয়েকজনের কথাতেও একই সুর শুনেছিলাম।
যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সীমান্ত ছাড়ছেন অনেকে
এদের অনেকের চাষের জমিই রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে। নিয়মিত তাদের চাষের কাজে যাওয়ার জন্য খাতায় নাম লিখিয়ে পরিচয়পত্র দেখিয়ে নির্দিষ্ট গেট পেরিয়ে যেতে হয়। আবার ফিরতেও হয় ঘড়ি ধরে।
কমল গাইন, দীপক মাঝিরা বলেন, কাঁটাতারের ওদিকে যা জমি আছে, তা বিএসএফ কিনে নিক, আমাদের পুনর্বাসন দিক। অন্য জায়গায় চলে যাব আমরা।
গৃহবধূ লক্ষ্মী সরকার বলেন, ‘যে যন্ত্রণা আমরা পোহাচ্ছি, এবার এলাকা বাড়ছে তো, ভেতরের লোকরাও বুঝবে।’
বিএসএফের এলাকা জিরো লাইন থেকে ১৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত করায় সীমান্তবাসীর যে প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়েছিলাম, লক্ষ্মী সরকারের এ একটা কথাতেই তা ফুটে উঠল।
সূত্র : বিবিসি