ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগের মামলায় বাংলাদেশের আলোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দুদক আইনের পৃথক দুইটি ধারায় ১১ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে ঢাকার বিশেষ জজ ৪নং আদালত। প্রভাব খাটিয়ে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের দায়ে ৪ বছর এবং মানি লন্ডারিংয়ের জন্য ৭ বছর কারাদন্ড এবং ৪৫ লক্ষ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৬ মাস কারাদন্ডসহ তার ব্যাংক একাউন্টে থাকা ৭৮ লক্ষ টাকা বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তবে উভয় সাজা এক সাথে চলার কারণে তাকে মোট ৭ বছর সাজা খাটার কথা রয়েছে, যদি না উচ্চ আদালত বা সরকার ভিন্নরূপ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে তো বটেই পৃথিবীতে প্রধান বিচারপতির সাজা হওয়া একটি বিরল ঘটনা। স্বৈরশাসক ইদি আমিনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার ৪ দিন পরে উগান্ডার প্রধান বিচারপতির লাশ ড্রেনে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। তবে বিচিত্র এই বাংলাদেশে প্রধান দুই দলের দুই রাষ্ট্রপতি দেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দ্বারা খুন হয়েছেন। দেশের সাংবিধানিক পট পরিবর্তনের কারণে সময়ে সময়ে আভির্ভূত সকল প্রভাবশালী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দি হয়েছেন। পুলিশ প্রধান, এন.এস.আই প্রধান জেল খেটেছেন এবং এখনো খাটছেন। তবে প্রধান বিচারপতির কারাভোগের আদেশ পৃথিবীতে একটি ব্যতিক্রম ঘটনা।
কাগজে কলমে রয়েছে, বিচার বিভাগ একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান? বাস্তবে কি তাই? প্রধান বিচারপতি বা বিচার বিভাগ কি জনস্বার্থে সরকার বা সরকার প্রধান বা রাষ্ট্র প্রধানের মুখোমুখি অবস্থান নিতে পারছেন? বিচার বিভাগ সকল বির্তকের ঊর্ধ্বে থাক, এটাই দেশবাসীর কামনা। তা কি সম্ভব হচ্ছে? সরকার আইন প্রণয়ন করে এবং সে আইনের বাস্তবায়ন ও প্রতিফলন ঘটে বিচার বিভাগের মাধ্যমে। সরকার আইন প্রণয়ন করে নিজেদের স্বার্থে, কিন্তু মানবতা ও ন্যায়পরায়নতা বিহীন আইনের প্রয়োগ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। ‘মানবতা’ ‘ন্যায় পরায়নতা’ আইনে লেখা থাকে না, কিন্তু থাকতে হয় বিচারকের মন মানসিকতায়। ‘ন্যায়ভিত্তিক আইন’ এবং ‘আইনভিত্তিক ন্যায়’ এক কথা নয়। এ দুটি বিষয়ে সূক্ষ্ম তারতম্য বুঝার বোধ শক্তি অনেকেরই থাকে না। অনেক বিচারককে বলতে শুনেছি যে, ‘আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ আমার নাই।’ বিচারকের চেয়ারে খচিত ‘দাড়ি পাল্লা’ ন্যায়ের প্রতীক, আইনের প্রতীক নয়। বিবেচনা বোধ, সামাজিক প্রেক্ষাপট যথাযথ উপলব্ধি করার মনোবিজ্ঞানসম্পন্ন মানসিকতা বা মেরুদন্ড সোজা রেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার নৈতিক ক্ষমতা কতজন বিচারকের রয়েছে? এ সব বিষয় এখন পাবলিক পারশেপসনে নিয়মিত পর্যালোচিত হচ্ছে। রাষ্ট্র প্রণীত আইন যদি ন্যায়ের সাথে সাংর্ঘষিক হয়, তবে সে আইন রদ ও রহিত করাই বিচারকের দায়িত্ব বলে মনে করি।
দেশে যতবার সামরিক আইন জারি হয়েছে ততবারই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে শপথ করিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। ব্যতিক্রম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকী। বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকী ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খাঁনকে শপথ পাঠ না করিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগমান করে ছিলেন। অতএব, বিচার বিভাগ সর্ব সময়ে জনস্বার্থে অবস্থান নিয়েছে, তা বলা যাবে না। সরকারের অপছন্দের লোক বা বিরোধী দলের উপর যে পুলিশ কর্মকর্তা যত অত্যাচার নির্যাতন করতে পারে, তার তত বেশি প্রমোশন হয়। বিচার বিভাগের প্রমোশন অনুরূপ নীতিতে হচ্ছে বলেই গণমানুষ মনে করে।
৯২% মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা বাংলাদেশ হওয়া স্বত্ত্বেও বিচারপতি সিনহাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত না হওয়ায় এটাই আবারো প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, বন্ধুরাষ্ট্র ভারত যার সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু তিনি প্রধান বিচারপতির শপথ নিয়েই সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটি মূর্তি স্থাপন করে এক বির্তক সৃষ্টি করে পরে তা স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই মূর্তি এখন সারাক্ষণ পুলিশ পাহারায় রাখতে হয়। দুর্নীতি দমন অধিদপ্তরকে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন বানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়। যারা দুদককে শক্তিশালী করেছেন সে সকল মন্ত্রী, এমপি, নেতা সকলকেই দুদক আইনে জেল খাটতে হয়েছে, হয়েছেন সাজা প্রাপ্ত, একারণে অনেকেই জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন নাই।
আমলাতন্ত্র বা আমলা কি ও তাদের Nature and Character কী ও কত প্রকার, তা বুঝা যায় যখন একজন আমলা রিটায়ার্ড করার পর তারই কলিকের নিকট পেনসনের টাকা আনতে যান। সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা উপলব্ধি করতে পারবেন, একজন বিচারপ্রার্থী বা আইনের বেড়াজালে আটকা পড়া মানুষ কতটুকু অসহায় এবং আদালতের গন্ডি পার হতে তাকে কতটুকু কাঠখড় পোড়াতে হয়। বিচারপতি সিনহার কথাবার্তায় বুঝা যেতো, তিনিই একমাত্র দেশপ্রেমিক এবং তিনি ছাড়া দুদক আইনে অভিযুক্ত সকলেই দুর্নীতিবাজ। এখন তিনি বুঝবেন, দুদক নখ-দন্তবিহীন হলেও কতটুকু হিংস্র। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রধান। দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় তিনিই শেষ আশ্রয়। অথচ ফাঁসির আসামির আপিল তিনি নিমিষেই শেষ করে দিতেন, পূর্ণাঙ্গ শুনানি করার সুযোগ তিনি কমই দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়ে তিনি বলেন, ৭০% পোস্ট মর্টেম রিপোর্টই ভূয়া। অথচ, তিনি নিজেই আপিল শুনানিতে পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই বিচারিক সিদ্ধান্ত নিতেন।
তিনি সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। আইনের বিধান মতে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে মামলায় কনটেস্ট করার কথা ছিল। কিন্তু বিচার চলাকালে, তিনি আত্মসমর্পণ করেননি, এখন করবেন কি না, তা সময়ই বলতে পারবে। আত্মসমর্পণ না করে আইনের ভাষায় তিনি ফিউজিটিভ হয়েছেন। তিনি হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছেন, আত্মসমর্পণ করলে সরকারের প্রভাবে তিনি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতেন এবং রিমান্ডসহ ন্যায়ের মানদন্ড তার প্রতি যথাযথভাবে প্রয়োগ হতো না। তিনি নিজের বেলায় বিচারিক সিদ্ধান্তে সরকারি প্রভাব এখন উপলব্ধি করতে পারছেন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রশ্নে তার সেই উপলব্ধি ছিল না কেন? পুলিশ রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের ভয় তাকে তাড়া করার কারণে হয়তো মামলার তদন্তাধীন সময়ে আত্মসমর্পণ করেননি। উল্লেখ করা যায়, প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
এস কে সিনহা ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১(ক) ধারায় হাইকোর্টের ক্ষমতা তার দেয়া বিভিন্ন রায়ের মধ্যে দিয়ে সংকুচিত করে দুদককে করেছেন অনেক শক্তিশালী। দুদকের আইনী ক্ষমতা বাড়িয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে করেছেন ন্যায় মানদন্ড থেকে বঞ্চিত, এখন সেই দুদকের বালুচরেই তিনি আটকা পড়েছেন।
প্রধান বিচারপতির সাজাতে বিচারিক অঙ্গন একটি মনস্তাত্বিক বা Conceptutal সমস্যায় পড়েছে। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হইবে।’ সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতার কারণে এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন বিচারিক বেঞ্চ আইনি ফয়সালা বা প্রদত্ব আইন নৈতিকতার পরিমাপে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি ও মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব পালন আর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা অন্য বড় কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন একই মানদন্ডে বিবেচিত হয় না। কারণ, বিচারিক বা ধর্মীয় দায়িত্ব ও সরকারি দায়িত্ব পালন বা আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত এক কথা নয়। রাষ্ট্রপতি এরশাদের সাক্ষরে অনেক আইন রয়েছে। তিনি দন্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও সে আইন চলমান। কিন্তু বিচারপতি যখন নিজেই বিচারিক সিদ্ধান্তে দোষী হয়ে পড়েন তখন তার প্রদত্ত রায়ে সৃজিত ‘আইন’ অনুসরণ, অনুকরণ নৈতিকতার প্রশ্নে মানুষের নিকট কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা মর্যাদাসম্পন্ন হবে, সেটা পর্যালোচনার দাবি রাখে বৈকি।
বিচারপতি সিনহাকে পেশার সহযাত্রী আইনজীবী হিসাবে পেয়েছি, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে তার কোর্টে ওকালতি করেছি। তার পড়াশুনা এবং understanding ক্ষমতা সম্পর্কে আমার ধারণা ভালো, কিন্তু তার বিচারিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ৭৪/৭৫ বছর বয়স্ক অসুস্থ একজন নারী হওয়া স্বত্ত্বেও সিনহাবাবু প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় বিচারিক সিদ্ধান্তেও কোনো আইনী সহায়তা পান নাই, ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী যা হওয়ার কথা ছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন ও এক কে সিনহা একই আইনে অর্থাৎ দুদক আইনে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এখন নিশ্চয় বিচারপতি সিনহার উপলব্ধি হবে বেগম খালেদা জিয়ার প্রশ্নে তার বিচারিক সিদ্ধান্ত কতটুকু নিরপেক্ষ ও মানবিক ছিল।
লেখক: তৈমুর আলম খন্দকার রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী