মেজর জিয়াউর রহমান সেদিন ব্যর্থ হলে ভারত বাংলাদেশ দখল নিতো: সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম

0

৭৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ বাংলাদেশ অস্থির এক সময় পার করে। অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের আশংকায় দিন যাপন করছিলেন রাজনীতিবিদ এবং সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ৫ নভেম্বর ব্যক্তিগত কারণে সেদিন ঢাকা সেনানিবাসের বাইরে ছিলাম। কিন্তু ৬ নভেম্বর সেনানিবাসে ফিরে সবার মাঝে ভেতর ভেতরে কিছু কথা বলাবলি শুনতে পাই। সন্ধ্যার পর কিছু লিফলেট হাতে আসে। যেখানে লেখা ছিল সৈনিক-সৈনিক ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। অফিসারদের কল্যা চাই। এ থেকেই বুঝা যায় রাতে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। সে লিফলেটে সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যার ইঙ্গিত ছিল পরিষ্কার। এ অবস্থায় কি করা যায় চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যাদের সাথে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমি তাদের কাছে যাবো। তবে সেটি এখন নয়। কারণ এখন গেলে তারা জানতে চাইবে কেন আমি এসেছি। তাই সময়ের অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাত ১২টা বাজতেই গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে ঢাকা সেনানিবাস। ব্যারাক ছেড়ে সৈন্যরা দলে-দলে ক্যান্টমেন্টের ভেতরে রাস্তায় নেমে আসে। প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। আমি মাথা নুয়ে ও হামাগড়ি দিয়ে দিয়ে এক কিলোমিটার দূরে আমি যাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি সেই ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে পৌঁছাই। তারা আমাকে চিনতে পেরে সাদরে গ্রহণ করে নেয়।

৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীতে একটি সমস্যা চলছিল। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বঙ্গভবন নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের কি হবে? তারা কি আবার ব্যারাকে ফিরে আসবে নাকি অন্য কিছু। আর যদি ফিরে আসে তাহলে তাদের কর্মের কি হবে। এসব বিষয় নিয়ে একটি টানাপোড়েন চলছিল। এ অবস্থায় ৩ নভেম্বর বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম একটি সেনা বিদ্রোহ করে ফেললেন। তার আগে ২ নভেম্বর রাত ১২টা্র পর খালেদ মোশাররফের অনুসারীরা সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে বন্দী করেন। খালেদা মোশাররফ নিজে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। তিনি বলেন, ৬ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, গণবাহিনী ও জাসদের মাধ্যমে যে বিপ্লব শুরু হয় তার নিয়ন্ত্রণ ভোর ৪টা ৫টার মধ্যেই তাদের হাত থেকে ফসকে যায়। এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সাধারণ সৈন্য বাহিনী। তারা ভোর সকালেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় প্রথমেই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে হবে। আর ইতোমধ্যেই ৩ নভেম্বরের বিদ্রোহের যারা নায়ক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সহ আরও তিন চারজনকে হত্যা করা হয়। যাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। জেনারেল জিয়া মুক্ত হয়ে জাসদের পরিকল্পনা মোতাবেক এ্যালিফ্যান্ট রোডে বা রেডিও বাংলাদেশের কক্ষে যাননি। এমনকি জাসদের সঙ্গে বৈঠকে বসেননি। তিনি প্রথমেই বিশৃঙ্খল সৈন্য বাহিনীকে শৃঙ্খলায় ফেরানোর উদ্যোগ নেন। সেদিন সকালে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কারো হাতে ছিল না। প্রত্যেকেই হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে, এক ভীতিকর পরিস্থিতি। জেনারেল জিয়াউর রহমান বিশৃঙ্খল সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, তিনদিন আগে সেনাবাহিনী যে শৃঙ্খলার মধ্যে ছিল আমি চাই সেনাবাহিনী সে শঙ্খলায় ফিরে যাক। সৈন্যদের যেসব অভিযোগ ও দাবি আছে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করা হবে। এক মাসের মধ্যে তিনি সৈন্যদের ৯০ ভাগ দাবি পূরণও করেছিলেন।

মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, সেদিনের পরিস্থিতি কথা শুনে উপলব্ধি করা যাবে না। সেদিন যদি জাসদের পরিকল্পনা মোতাবেক সেনাবাহিনীর দুই গ্রুপে যুদ্ধ শুরু হতো তাহলে ভারত বাংলাদেশের ভেতরে সরাসরি অভিযান চালাতো। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নষ্ট হতো। সেই সাথে দেশে গৃহযুদ্ধের সূচনা করা হতো। কিন্তু জিয়াউর রহমান তার বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞার মাধ্যমে সৈন্যদের শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন আর জাসদের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। আর এজন্যই ৭ নভেম্বরকে বলা হয় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস।

–মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক। (আমাদের সময়, ৭ নভেম্বর ২০১৯.)

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com