চিঠি দিয়েই ইসির দায় এড়ানোর চেষ্টা

0

ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে সহিংসতা বন্ধে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে চিঠি ও সভা করেই দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ চিঠি পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা।

সহিংসতা বন্ধে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর থাকতে একটি আধা সরকারিপত্রে (ডিও) গত ৪ নভেম্বর স্বাক্ষর করেন ইসি সচিব। গতকাল পর্যন্ত ওই ডিও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে পৌঁছেনি। এবার মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনকে আরেকটি চিঠি দিয়ে সহিংসতা বন্ধে স্থানীয়ভাবে সভা করার নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে কমিশন।

এছাড়া সহিংস ঘটনার দু-চারটি ছাড়া বাকিগুলোর বিষয়ে তদন্ত হয়নি। এগুলোতে প্রার্থিতা বাতিলসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কঠোর পদক্ষেপও। শরীয়তপুরের চিতলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাল স্বাক্ষরে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘটনার সত্যতা পেয়েছে ইসির তদন্ত কমিটি। সোমবার ওই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন বাতিল করা হলেও রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম মঙ্গলবার রাতে বলেন, সহিংসতা বন্ধে আমরা বরাবরই কঠোর অবস্থানে আছি। যেসব স্থানে সহিংসতা হয়েছে সেখানে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাকে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শরীয়তপুরের চিতলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়টি তদন্ত করে তা বাতিল করতে বলেছি। আরেক জায়গায় প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে সহিংসতায় কমবেশি ৩০ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশ। ইসি সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ৩৬৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তুলনামূলক সহিংসতা কম হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ ঘিরে সহিংসতা বাড়তে থাকে। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কত সহিংস ঘটনা ঘটেছে, এতে কতজন মারা গেছেন ও কতজন আহত হয়েছেন তার কোনো পরিসংখ্যান নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই। এসব ঘটনা দেখভালে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো মনিটরিং সেল গঠন করা হয়নি। শুধু ভোটের দিনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পুলিশ, র‌্যাব, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য নিয়ে ‘আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় ও মনিটরিং সেল’ গঠন করা হয়। তবে যেসব ঘটনা গণমাধ্যমে বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়, স্থানীয় প্রশাসন থেকে চিঠি দিয়ে ইসিকে জানানো অথবা বিভিন্ন মহল থেকে তদবির আসে সেগুলোর কিছু ঘটনা তদন্ত করা হয়। এরই একটি হচ্ছে-শরীয়তপুরের চিতলিয়া ইউনিয়ন।

সহিংসতা বন্ধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের কোনো ধরনেরই পদক্ষেপ নেই বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সহিংসতা হলে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া, পরিস্থিতি বেসামাল হলে সেখানে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া কমিশনের কাজ। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে এর কোনোটি করতে দেখিনি। তিনি বলেন, কমিশনের কার্যক্রম দেখলে মনে হয় না মাঠ পর্যায়ে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে। নির্বাচন কমিশনাররা সরকারি বেতন-ভাতা নিচ্ছেন কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না।

জানা গেছে, গত ৪ নভেম্বর নরসিংদীর সদর উপজেলার আলোকবালি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। ওই ঘটনায় অন্তত ৩০ জন আহত হন। রক্তক্ষয়ী এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে নির্বাচন কমিশন কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম সম্প্রতি ওই জেলা সফর করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নরসিংদীর সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মেছবাহ উদ্দিন বলেন, ওই ঘটনার পর ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। মামলাও দায়ের হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। এর আগে গত ১৬ অক্টোবর মাগুরা জেলার সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হামলা-পাল্টাহামলায় চারজনের মৃত্যু হয়। কয়েকজন আহত হন। ওই ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি ইসি। ওই ঘটনার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা গত ২১ অক্টোবর সফর করেন। সিইসির এ সফরের পর আবারও সহিংসতা হয় ওই জেলায়। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলিয়া সহিংসতায় দুজন মারা গেছেন। ওই ঘটনায় তদন্ত করেনি ইসি। এ বিষয়টিও স্থানীয় পুলিশের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। একইভাবে অন্যান্য ঘটনায় ইসির পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জাল স্বাক্ষরে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে ব্যবস্থা নেই : শরীয়তপুরের চিতলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের স্বাক্ষর জাল করে প্রত্যাহারের ঘটনায় সত্যতা পেয়েছে নির্বাচন কমিশনের তদন্ত কমিটি। ওই ঘটনায় রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেনের দায় পেয়েছে কমিটি। একই সঙ্গে শরীয়তপুর জেলা ও সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার অবহেলা ও গাফিলতি চিহ্নিত করেছে কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার ওই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বাতিল করা হয়। তবে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, সামনে নির্বাচন নিয়ে কমিশন ব্যস্ত আছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এখনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

সহিংসতা বন্ধের ডিও পাঁচ দিনেও যায়নি : মাঠ প্রশাসনে সহিংসতা বন্ধে ম্যাজিস্ট্রেট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের তৎপর হতে গত ৪ নভেম্বর চারটি আধা সরকারিপত্রে স্বাক্ষর করেন মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পুলিশের আইজিকে ওই ডিও লেখা হয়। এতে সহিংসতায় ইসির উদ্বেগ জানিয়ে তা বন্ধে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে বলা হয়। ওই চিঠি গতকাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পৌঁছেনি বলে জানা গেছে।

এদিকে সহিংসতা বন্ধে মাঠ প্রশাসনে আরেকটি চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি এবং আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওই চিঠি পাঠানো হবে। চিঠিতে সহিংসতা বন্ধে স্থানীয়ভাবে সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com