হঠাৎ তৎপরতায় বিপাকে বিএনপি
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামিনে মুক্ত হতে পারেন—এমন একটি গুঞ্জন বিএনপির ভেতরে-বাইরে চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। আর সে কারণেই দলটির মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা কিছুটা বেড়ে যায়। কিন্তু সর্বশেষ গত মঙ্গলবার হঠাৎ করেই দলের নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ মিছিলে কিছুটা বিপাকে পড়েছে বিএনপি।
জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে সুপ্রিম কোর্ট অভিমুখে ওই মিছিল ঘিরে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়াধাওয়ি এবং ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে ৫০০ জনকে আসামি করে। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়ার পর কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জামিন পেলেও নতুন করে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে।
তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে অনুষ্ঠিত ওই মিছিলের বিষয়টি বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতার জানা ছিল না। সবাই জানলে পুলিশ বাধা দেবে—এমন কৌশল থেকে বিষয়টি গোপন রেখে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ থেকে হঠাৎ করে মিছিল নিয়ে যাওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের দিকে। একপর্যায়ে পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ বাধে এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। কিন্তু খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের ওপর আপিল বিভাগে শুনানির এক দিন আগে এমন ঘটনায় দলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সবাই ওই কর্মসূচি পছন্দ করেননি।
জামিন হতে পারে—এমন আশাবাদী নেতারা বলছেন, বিক্ষোভ মিছিল করে পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত করা ঠিক হয়নি। তাঁদের মতে, ওই ঘটনায় পুলিশকে নতুন করে ধরপাকড়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার জামিন লাভের সম্ভাবনাও এতে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত হঠকারিতা করে ওই মিছিল করিয়েছেন। সম্ভবত তিনি সরকারের ফাঁদে পড়েছেন। ওই নেতা আরো বলেন, আবার এটি স্যাবোটাজও হতে পারে। ইশতিয়াক আজিজ উলফাতকে গত বুধবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান অবশ্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা অবশ্যই ওই কর্মসূচির কথা জানতেন। না জানলে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী কর্মসূচিতে আসলেন কী করে?’ সাদেক খান দাবি করেন, দলের শীর্ষ পর্যায়ের সবুজ সংকেতেই বিক্ষোভ মিছিল করা হয়েছে।
তবে ওই দিন মিছিলে অংশগ্রহণকারী একাধিক নেতা নিশ্চিত করেছেন, রিজভী মিছিলে ছিলেন না। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা দল ও পেশাজীবী নেতারা আয়োজন করলেও কৌশলগত কারণে ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে ওই দিন কর্মসূচি পালন করা হয়।
হঠাৎ করে বিক্ষোভ মিছিল করার ওই ঘটনা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জানত কি না জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে জানা না জানার বিষয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সমাবেশ, মিছিল করা বিএনপির গণতান্ত্রিক অধিকার।’ তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি ঠাকুরগাঁও ছিলাম; অথচ আমাকেও আসামি করা হয়েছে।’ সুতরাং বোঝাই যায়, বিএনপিকে দমন করার জন্য সরকার সুযোগ খুঁজছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় বিএনপি ওই কর্মসূচির কথা জানত কি না, আমার জানা নেই। তবে আমি ছিলাম না। তা সত্ত্বেও আসামি হয়েছি।’
মঙ্গলবারের সমাবেশ ও মিছিলে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির এমন এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পেশাজাজীবী কয়েকজন নেতাসহ মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতারা কর্মসূচি জানতেন। কৌশলগত কারণে সবাইকে বলা হয়নি। বললে ফাঁস হয়ে যেত এবং পুলিশ প্রেস ক্লাব থেকে বের হতে দিত না।’
আরেক নেতা বলেন, আসলে পুলিশের ভয়ে অনেক দিন ধরে বিএনপির নেতাকর্মীরা আড়ষ্ট হয়ে ছিলেন। তাঁদের ভয় ভাঙানোর জন্যই ওই দিন মিছিল করা হয়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যেও কেউ কেউ আগ্রহী হয়েছেন বলে ওই নেতা দাবি করেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, অনুমতি না নিয়ে সমাবেশ করার সক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই বিএনপির নেই।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই দিনের কর্মসূচির কথা সবাই জানত কি না বলতে পারব না। তবে আমি জানি না। তা ছাড়া স্থায়ী কমিটির দু-একজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তাঁরাও জানেন না।’
খালেদা জিয়ার কারামুক্তি নিয়ে গুঞ্জন! : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন—এমন একটি গুঞ্জন ও আলোচনা এক মাস ধরে বিএনপির ভেতরে ও বাইরে ছড়িয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, এমন আলোচনা কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পায় গত ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যালিস ওয়েলসের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠকের পর। কারণ ওই বৈঠকে বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানায়। এর আগে ২৮ অক্টোবর রাজধানীর এক হোটেলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকেও খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়।
গত ২৫ অক্টোবর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তাঁর এক স্বজন বলেন, ‘খালেদা জিয়া জামিন পেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে আমরা বিদেশে নিতে চাই।’
এদিকে এমন গুঞ্জনের মধ্যেই গত ১৭ নভেম্বর খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য আবেদন করেন তাঁর আইনজীবীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার ওই আবেদনের শুনানি শেষে খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট চেয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। বিএনপির অনেকে এ ঘটনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মাঠে নেমেছে বিএনপি। গত ২৪ নভেম্বর নয়াপল্টনে দলের উদ্যোগে সমাবেশ হয়। আর সর্বশেষ মঙ্গলবার সমাবেশ শেষে অনুষ্ঠিত হয় হঠাৎ বিক্ষোভ মিছিল। অনেকের মতে, এসব ঘটনার একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসূত্র রয়েছে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যোগসূত্রের কথা বলতে পারব না। তবে সরকার চাইলে জামিন হবে, না চাইলে হবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘বিএনপি নেত্রীর স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই মেডিক্যাল রিপোর্ট বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে জামিন দেওয়া উচিত। এক বছর ১০ মাস তো হয়ে গেল!’