এমসি কলেজ ছাত্রবাসে গণধর্ষণ মামলার চার্জ গঠন পেছাল
সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে গৃহবধূ গণধর্ষণ মামলার অভিযোগ গঠনের তারিখ পিছিয়েছেন আদালত। চ্যাঞ্চল্যকর এ মামলাটি বিচারের জন্য অভিযোগ (চার্জ) গঠনের তারিখ ছিল রোববার (৩ জানুয়ারি)।
এ দিন চার্জশিটে অভিযুক্ত আটজনকেই সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহিতুল হকের আদালতে এনে হাজির করা হয়। তবে অভিযোগপত্র পর্যালোচনা এবং নারাজি দাখিলের জন্য সময় প্রার্থনা করেন মামলার বাদী পক্ষ।
মামলার বাদী আগামী ১০ জানুয়ারি ধার্য তারিখে নারাজি দাখিল করে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য আবেদন করবেন বলে আদালতকে জানিয়েছেন বাদীর আইনজীবী।
এছাড়া আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে জামিন প্রার্থনা করেন মামলার অভিযোগপত্রের আসামি অর্জুন লস্কর। জামিন আবেদন শুনানি শেষে তা নামঞ্জুর করেন বিচারক।
সংশ্লিষ্ট আদালতের পিপি রাশিদা সাইদা খানম জানান, মামলার বাদীপক্ষ এ সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করবে। তাদের নারাজি না থাকলে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচারকাজ শুরু হবে আগামী ১০ জানুয়ারি।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে একটি রাস্তায় স্বামীকে আটকে প্রাইভেটকারের ভেতর ওই গৃববধূকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করেন ছাত্রলীগের ছয় নেতাকর্মী। ঘটনার রাতেই নির্যাতিতার স্বামী বাদী হয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) শাহপরান থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন।
পরবর্তীতে ওই ছয় আসামিসহ সন্দেহভাজন আরও দুজনকে গ্রেফ্তার করে র্যাব ও পুলিশ। গ্রেফতার হওয়া আটজনই মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ফৌজধারী দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
মামলাটি তদন্ত করে গত ৩ ডিসেম্বর গ্রেফতার ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য।
অভিযুক্তরা হলেন- ছাত্রলীগ কর্মী ও এমসি কলেজের ছাত্র সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল, মিসবাউল ইসলাম রাজন মিয়া, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম।
অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজন মিয়াকে সরাসরি ধর্ষণে সম্পৃক্ত এবং রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুমকে ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই আটজনই বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন।
এদিকে, ধর্ষণের অভিযোগে দাখিল করা মামলাটি গত ৩ ডিসেম্বর নারী ও শিশু নির্যতন দমন ট্রাইব্যুনালে এবং গত ২৭ ডিসেম্বর চাঁদাবাজি ও মারধরের অভিযোগের মামলাটি সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য বদলি করেন সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম (দ্বিতীয়) আদালতের বিচারক সাইফুর রহমান। তাছাড়া অস্ত্র আইনের মামলাটির অভিযোগপত্র (চার্জশিট) পর্যালোচনার জন্য মুখ্য মহানগর হাকিম (দ্বিতীয়) আদালতে রাখা হয়েছে বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে সিলেট এমসি কলেজে ওই গৃহবধূকে গণধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে এসএমপির শাহপরান থানায় মামলা করেন। আর রাতে কলেজ ছাত্রাবাসে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বন্দুক ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।
এর মধ্যে ৩ ডিসেম্বর সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) মো. আবুল কাশেমের আদালতে এই চার্জশিট প্রদান করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। ওই মামলাগুলোর মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে দাখিল করা মামলাটি দুভাগে চার্জশিট দাখিল করা হয়। যার একভাগ ছিল গণধর্ষণের অভিযোগপত্র। আর অপরটি ছিল চাঁদাবাজি ও মারধরের অভিযোগে মামলাটি।
এর আগে গত ১ অক্টোবর ও ৩ অক্টোবর দুদিনে এ মামলায় গ্রেফতার আট জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি সেন্টারের ডিএনএ ল্যাবে নমুনা সংগ্রহের পর পাঠানো হয় ঢাকার ল্যাবে। সেখান থেকে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন প্রথমে আদালতে এসে পৌঁছায়। পরবর্তীতে এ প্রতিবেদন তদন্ত কর্মকর্তার হাতে এসে পৌঁছে ২৯ নভেম্বর।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, হাইকোর্টের নিদের্শে গঠিত তদন্ত কমিটি সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হলরুমে গত ৪ অক্টোবর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এ ঘটনায় গণশুনানি করে। পরে কমিটির সদস্যরা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের গণধর্ষণের ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে গত ১৬ অক্টোবর ১৭৬ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্ট বেঞ্চে জমা দেয়া হয়েছে। যার শুনানি হয় ২০ অক্টোবর। ওই দিন শুনানি শেষে প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এদিকে এ ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে ২৬ অক্টোবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও কলেজের অধ্যক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দোহাই দিয়ে কলেজ কমিটির এ প্রতিবেদনটি সিলগালা করে রাখেন। এছাড়া গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িত চার আসামির ছাত্রত্ব এবং সনদ বাতিল করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে এমসি কলেজ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন- সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসান।
এর আগে ঘটনার কয়েকদিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গণধর্ষণের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি এমসি কলেজে তদন্ত করতে আসে। তদন্ত শেষে তারা তাদের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।