অহংকারী মানুষ বেহেশতে যেতে পারবে না
অহংকার প্রকাশের একটি সুনির্দিষ্ট আচরণ নির্ণয় করেও কিছু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন হজরত আবু হুরায়রা রাজি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (পূর্বযুগে) একজন লোক ছিল, যে উন্নতমানের এক প্রস্থ পোশাক পরে চলছিল, যা তাকে আত্মম্ভরিতায় নিমজ্জিত করেছিল। মাথা ছিল চিরুনিকৃত, সে পথ চলছিল দাম্ভিকতার সাথে। ঠিক তখন আল্লাহ তাকে ভূমিতে দাবিয়ে দিলেন। লোকটি কিয়ামত পর্যন্ত মাটিতে ধসতেই থাকবে, ধসতেই থাকবে। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
অপর একটি হাদিসে আছে, হজরত আবু হুরায়রা রাজি. থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির প্রতি করুণার নজরে তাকাবেন না, যে তার লুঙ্গি-পায়জামা-প্যান্ট অহংকারবশত টাখনুর নিচে পরিধান করে’। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
এ দুটো হাদিসের প্রথমটিতে উন্নতমানের পোশাক পরাকে নয়, বরং পোশাকের বা সাজসজ্জার কারণে দাম্ভিক হয়ে উঠে বা অহংকার প্রদর্শন করাকে মারাত্মক অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য পাপ বলে বোঝানো হয়েছে। মাশাআল্লাহ, আমরা অনেকেই হয়তো এহেন পাপচিন্তা ও অন্যায় অভ্যাসে আক্রান্ত নই। কিন্তু আমাদেরই মাঝে এ ধরনের সাজ-পোশাক ও ঠাটপাট নিয়ে আত্মম্ভরিতায় ভোগের লোকের সংখ্যা নেহাত কমও নয়।
আসলে অহংকার তো পোশাকে নয়, অন্তরেই বাসা বাধে। আর অন্তরের অহংকার ও দম্ভই মানুষের পোশাকে, আচরণে প্রকাশ পেতে থাকে। সাধ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী হালালভাবে উপার্জিত দামি-সুন্দর পোশাক পরতে নিষেধ নেই; যদি তা অপব্যয়ের পর্যায়ে বা অহংকারের উদ্দেশ্যে না হয়ে থাকে। বস্তুত হাদিসে বর্ণিত ব্যক্তির সাজ-পোশাক নয়, আত্মম্ভরিতাই তাকে আল্লাহর গজবে নিপতিত করেছে।
দ্বিতীয় হাদিসটিতেও লুঙ্গি-পায়জামা-প্যান্ট টাখনুর নিচে পরিধানের কথাটির সঙ্গে ‘অহংকারবশত’ শর্তটি জুড়ে রয়েছে। কেননা, শত সতর্কতার মাঝেও কখনো কারো টাখনুর নিচে কাপড় নেমে যেতে পারে। এ কাজ মনের ভুলে বা অনিবার্য প্রয়োজনে বা পোশাকের আকার-আকৃতি ও ধরনের কারণেও হতে পারে। যদি এ রকমটি কারো সাথে নিয়মিত বা স্থায়ীভাবে না দেখা যায়, বরং মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে তবে তাকে এ হাদিসের উদ্দেশ্যকৃত ব্যক্তি বলে গণ্য না করাই উচিত হবে।
কারণ, এ আচরণের সঙ্গে অহংকারের শর্ত রয়েছে। কাজেই আমরা যেন অহংকারবশত টাখনুর নিচে পোশাক না পরি। সেই সঙ্গে ভুল, অপারগতা বা প্রয়োজনবশত কাউকে পরতে দেখে প্রকৃত কারণ না জেনে তার ব্যাপারে কুধারণা ও বদনাম জুড়ে না দিই। কেননা, এ রকম করাটাও জঘন্য ও গর্হিত কাজ। আমরা কোনোভাবেই দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর রহমতের নজর থেকে বঞ্চিত হতে চাই না।
এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি হাদিস নিম্নরূপ, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাজি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার রয়েছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’
জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, ‘কোনো মানুষ যদি চায় তার উত্তম পোশাক হোক, তার জুতো সুন্দর হোক, তা হলে এটা কি অহংকার?’
জবাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ সুন্দর! তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। অহংকার হলো, সত্যকে অস্বীকার করা ও মানুষকে হেয় ও তুচ্ছজ্ঞান করা।’ (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিসটির মাধ্যমে আমরা সম্ভাব্য বিভ্রান্তি ও অহেতুক গোঁড়ামি থেকে মুক্ত থাকতে পারি। কেননা, অহংকার বা দম্ভ ব্যতিরেকে কেবল সরল সৌন্দর্যবোধ ও রুচিশীলতা থেকে উত্তম পোশাক ও সাজসজ্জা নিষেধ তো নয়ই, বরং আল্লাহরও তা-ই পছন্দ। হাদিসের শেষাংশের ঘোষণা ও ব্যাখ্যা আমাদের জন্য বিশাল ছাড় ও উৎসাহপূর্ণ বটে। তবে হাদিসটির প্রথমাংশের ওপরেই আমাদের অধিক দৃষ্টি, চিন্তা ও আমল থাকা উচিত। যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার থাকলেও জান্নাতের দরজা বন্ধ অর্থাৎ জাহান্নাম অবধারিত।
কতই না ভয়াবহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই উচ্চারণ। আমরা যখন অহংকার থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত হতে পারব, আর নিজের অনিচ্ছায় অজান্তে লালিত ছিটেফোঁটা অহংকারের ব্যাপারেও সদা সতর্ক ও তৎপর থাকব; তখনই আমরা মুক্তির আশা করতে পারব, এর আগে নয়। বাস্তব তো এই যে, শুধু দুনিয়ার সম্পদ ক্ষমতা ও সৌন্দর্যই নয়; আমরা অনেক সময় দ্বীনি কর্মকান্ড বা প্রতিষ্ঠানেও প্রভাব পরিচয় নিয়ে অহংকারী হয়ে থাকি। এমনটি মোটেও কাম্য নয়।
আমাদের সোজা কথাটি বুঝতে হবে যে, নিরহঙ্কার মানুষ হতে পারাটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত্রের অন্যতম ও বিশালতম এক সুন্নত; যা আমরা প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করেও হয়তো অনেক সময় নিজেদের খুব সুন্নতওয়ালা ভেবে থাকি। অথচ এ অহংকারমুক্ত থাকার সুন্নতটির ওপর আমল না করতে পারলে কেবল সাজ-পোশাকের সুন্নত আমাদের অবধারিত জাহান্নাম থেকে বাঁচাবে না। তাই আমরা প্রকৃত নিরহঙ্কার হওয়ার চেষ্টা করি এবং আল্লাহ পাকের কাছে তা কামনা করি।