বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা কিছুটা কমলেও দেশে নারী-শিশু নির্যাতন বেড়েছে

0

বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা কমলেও দেশে নারী ও শিশুর মানবাধিকার পরিস্থিতি বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। ধর্ষণ যেমন বেড়েছে, তেমনি নারী-শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের ধরন পাল্টেছে। থামেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। সাংবাদিক নির্যাতন ও হেনস্তাও চলছে। এছাড়া ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে আগুন দেওয়া এবং সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার খবরও মিলছে প্রায়ই। এমন পরিস্থিতিতে আজ ১০ ডিসেম্বর সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও মানবাধিকার লংঘনের অতীত ধারাবাহিকতার চিত্র এতটুকু পাল্টায়নি এবং পরিস্থিতি যথেষ্ট নাজুক।

মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বিভিন্ন বয়সী ১ হাজার ৫৪৬ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে। এর আগে ২০১৯ সালের ১২ মাসে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের তথ্য জানিয়েছিল সংস্থাটি। এছাড়া চলতি বছরের ১১ মাসে ৫৩৫ শিশুহত্যাসহ ১ হাজার ৬৩৮ শিশু শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সম্প্রতি মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে খুলনার বটিয়াঘাটা, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ ও সাতক্ষীরা সদরে তিন শিশুসন্তানকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে খোদ বাবা ও মায়ের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের ১২ মাসে ৪৮৮ শিশুহত্যার তথ্য জানিয়েছিল আসক।

বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার নারী ও শিশু। আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবির)-এর তথ্যমতে ২০১৯ সালের তুলনায় চলতি বছর নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ৭০ শতাংশ। বছরের প্রথম ৯ মাসে শুধু পারিবারিক নির্যাতনে মারা গেছেন ২৩৫ নারী। টিআইবির হিসাবে চূড়ান্ত বিচারে মাত্র ১ শতাংশ ভুক্তভোগী নারী ন্যায়বিচার পেয়েছেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে করোনাকালীন সংকট, পরিবারে আর্থিক দুরবস্থা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, নৈতিক মূল্যবোধের ঘাটতি, পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, অপরাধের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং কিছু ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘করোনার সংকটকালীন বিচারবহির্ভূত হত্যা কিছুটা কমেছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো নারী ও শিশু নির্যাতন মারাত্মকভাবে বেড়েছে। নির্যাতনের ধরন, প্রেক্ষাপট ও নৃশংসতার ধরনও পাল্টেছে। যারা অপরাধী তারা হয়তো বুঝে ফেলেছে যে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কীভাবে বের হওয়া যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আসলে সচেতনতা, নৈতিক মূল্যবোধ বাড়ানো এবং নারী ও শিশুর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা না গেলে এই নির্যাতন ও নৃশংসতা বাড়তেই থাকবে।’

আসকের তথ্যমতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে গ্রেপ্তারের আগে ও পরে ‘ক্রসফায়ার’, ‘এনকাউন্টার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শারীরিক নির্যাতন ও হেফাজতে মোট ২২০ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে গ্রেপ্তারের আগে ১৪৮ জন এবং গ্রেপ্তারের পরে ৩৯ জন ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এই সময়ে পুলিশ ও র‌্যাবের নির্যাতনে ১৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের (৩৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার) তুলনায় চলতি বছরের শেষ কয়েক মাসে এটি কিছুটা কমেছে। গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.)  সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের নিহত হওয়া এবং গত ১১ অক্টোবর সিলেটে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবক রায়হান আহমদের (৩৩) মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া ও দায়ীদের গ্রেপ্তারের কারণে এই প্রবণতা কমেছে বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। অন্যদিকে চলতি বছরের ১১ মাসে দেশের বিভিন্ন সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ৩৫ জন এবং তাদের নির্যাতনে ৬ জনসহ মোট ৪১ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

আসকের চেয়ারপারসন ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই (জহিরুল ইসলাম) খান পান্না বলেন, ‘সার্বিকভাবে অতীতের তুলনায় মানবাধিকার পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। দুই-একটি বিচারবহির্ভূত হত্যায় ব্যাপক সমালোচনা ও পল্লবীর জনি হত্যা মামলায় কয়েকজন পুলিশের সাজা হওয়ার কারণে বিচার বিভাগীয় হত্যা হয়তো কিছুটা কমেছে। কিন্তু নানা কারণে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা খুবই বাজে পর্যায়ে চলে গেছে। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিষয়ে উচ্চ আদালতের বেশ কিছু নির্দেশনা ছিল। এগুলো বাস্তবায়ন করলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতো।’

জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের হতাশা আছে। একটা সময় পর্যন্ত মানুষ জঙ্গলে বসবাস করতে পারে। কিন্তু যখন সভ্যতার ছোঁয়া পায় তখন তাকে যতই পেছনে নেওয়ার হাজার চেষ্টা করা হোক না কেন, সেটি সম্ভব হয় না। তাই আমাদের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতেই হবে।’ 

এদিকে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা সরকারসহ বিভিন্ন মহল থেকে জোরেশোরে বলা হলেও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতন। আসকের হিসাবে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২৩৩ জন সাংবাদিক হয়রানি, হেনস্তা, আক্রমণ ও মারধরের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের জেরে এই সময়ে ৮৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা। অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে রয়েছে। কার্টুনিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মীকে যদি গ্রেপ্তার করা যায়, তাহলে যারা সাম্প্রদায়িক উসকানি সৃষ্টি করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাদের গ্রেপ্তার করা যায় না কেন?’ 

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘মানবাধিকারের যে পরিস্থিতি তাতে একে উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হবে। এমন কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না যে, মানবাধিকার পরিস্থিতি বিগত বছরের চেয়ে এবার একটু ভালো। বিচারবহির্ভূত হত্যার আলোচিত কোনো ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে যখন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় তখন সাময়িককালের জন্য এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হতে এর আগেও দেখেছি। তাই এখনই বলা যাবে না যে এটি বন্ধ হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন শুধু গুম আর ক্রসফায়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যে কোনো মানুষকে এখন যে কোনোভাবে হেনস্তা করা খুব সহজ হয়ে গেছে। এর মধ্যে নারী ও শিশুর মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। করোনাকালীন কয়েক মাস গৃহে আটকে থাকা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ মোকাবিলা করতে গিয়ে সমাজে বা পরিবারে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে এবং সে অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নারী ও শিশুদের ওপর।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com