পদত্যাগ ‘ষড়যন্ত্র’ কিনা খতিয়ে দেখছে বিএনপি
সিনিয়র কয়েক নেতার পদত্যাগে বিএনপিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ নিয়ে চিন্তিত ও বিব্রত হাইকমান্ড। আরও যারা করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
এটা দলে ভাঙন সৃষ্টির কোনো ষড়যন্ত্র কিনা, সে ব্যাপারে সতর্ক হাইকমান্ড। এ মুহূর্তে পদত্যাগের কারণ কী হতে পারে- তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। একই সঙ্গে যারা এরই মধ্যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তাদের ব্যাপারেও সন্ধান চলছে। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, হাইকমান্ডের ওপর ক্ষোভের পাশাপাশি ‘সরকারের চাপ’ বড় একটা কারণ হতে পারে।
সূত্র জানায়, আরও যেসব নেতার পদত্যাগের গুঞ্জন রয়েছে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। আর কেউ যাতে এমন অবস্থান না নেন- সে ব্যাপারে দলটির হাইকমান্ড সতর্ক।বিশেষ করে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আগ পর্যন্ত অভিমানী নেতাদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। তবে দলের এক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে জানান, যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি।
এছাড়া যারা সামনে পদত্যাগ করবেন তাদেরটাও গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত হাইকমান্ডের। যারা দল ছাড়বেন তারা ছেড়ে যাক, কিন্তু আগামী কাউন্সিলের আগে কৌশলগত কারণে কারও পদত্যাগের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হবে না। পদত্যাগপত্র হাতে পাননি বলে তা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হবে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান মহাসচিব বরাবর পদত্যাগপত্র দিয়েছেন দাবি করলেও তা পাননি বলে জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রোববার মাহবুবুর রহমানের মায়ের ইন্তেকালের পর মির্জা ফখরুল শোক জানান।
শোকবার্তায় তাকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সিলেটের মেয়র আরিফুল হকসহ ছয় নেতা পদত্যাগপত্র দিলেও তা গ্রহণ করা হয়নি।
দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, আদর্শিক কারণে কেউ দল ছাড়বেন বলে তারা মনে করছেন না। কারণ দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলেও হামলা-মামলা নির্যাতন সহ্য করে তারা দলে আছেন। তাছাড়া এ মুহূর্তে দল ত্যাগ করে অন্য দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া ততটা সহজ হবে না। দলে শিগগিরই অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসবে। তাই কোনো কারণে কারও ক্ষোভ থাকলে তা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে। হাইকমান্ড থেকে এমন বার্তাই দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, সরকার অনেক আগে থেকেই বিএনপিকে নির্মূলের চেষ্টা করছে। সেজন্য তারা বহু মামলা-মোকদ্দমা দিয়েছে। বিতর্কিত একটা নির্বাচন করার পরও যখন দেখছে যে, বিএনপিকে কিছু করা যাচ্ছে না, তখন তারা এবং তাদের এজেন্সিগুলো বিভিন্ন প্রচার চালাচ্ছে। নেতাদের পদত্যাগ তারই একটা অংশ হতে পারে।
এদিকে বুধবার এক অনুষ্ঠান শেষে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যাওয়ার মতো অবস্থা এখন নেই। বরং আওয়ামী লীগ থেকেই বিএনপিতে আসার অবস্থা তৈরি হয়েছে। তার এমন বক্তব্যেও নেতারা ইতিবাচক কিছু দেখছেন।
বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরীর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দলে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেও পরে তিনি বিকল্পধারায় যোগ দেন। ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী পদত্যাগ করে সরাসরি যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
এরপর পদত্যাগ করেন খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগার লবী, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহ আলম, কেন্দ্রীয় সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন, বগুড়ার প্রভাবশালী নেতা মো. শোকরানা।সর্বশেষ দল থেকে পদত্যাগ করেন ভাইস চেয়ারম্যান মোরশেদ খান। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানও দলের মহাসচিব বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানান। আর কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পরপরই পদত্যাগ করেন ভাইস চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু।
দলীয় সূত্র জানায়, সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকজন নেতা (যারা পরে দলে ফিরেছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ) আবারও বিএনপির বিরুদ্ধে একত্র হওয়ার চেষ্টা করছেন বলে হাইকমান্ডের কাছে তথ্য রয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েকজন সংস্কারপন্থী নেতা, যারা এখনও দলে ফিরতে পারেননি। দলে নিষ্ক্রিয়, ব্যবসায়িকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিজ এলাকায় কোণঠাসা নেতাদেরও টার্গেট করে বিএনপি থেকে পদত্যাগের চাপ দিচ্ছেন তারা। ইতিমধ্যে সংস্কারপন্থী নেতাদের নজরদারিতে রেখেছে বিএনপি।
সূত্র জানায়, নেতাদের পদত্যাগের নেপথ্য কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন বিএনপি নেতারা। বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে দল ছাড়ার পেছনে তারা বেশ কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যেসব ব্যবসায়ী নেতা আছেন তাদের ব্যবসায় কর, ভ্যাটসহ নানা ঝামেলা আছে।
বিএনপি করার কারণে তাদের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা। ভবিষ্যতে আরও হয়রানির শিকার হতে পারেন- এমন শঙ্কায় নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। পদ-পদবি নিয়ে অসন্তোষ ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে মূল্যায়ন না করাও পদত্যাগের আরেকটি কারণ বলে জানা গেছে। এসব কারণের পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে দলে ভাঙন সৃষ্টির কোনো তৎপরতা আছে কিনা- সে ব্যাপারেও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি দলের সুসময়ে অনেকেই এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। নেতাকর্মীদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে খালেদা জিয়া যে সরকার গঠন করেছিলেন তখন অনেক নামিদামি নেতা আমাদের দলে এসেছেন। তাদের দেখে মনে হয়, দেশের এমন পরিস্থিতিতে এখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, আর সহ্য হচ্ছে না। সে কারণে তারা প্রস্থান করতে চান। দুই-একজন দল ছাড়লে বিচলিত হওয়ার কিছুই নেই।
তিনি বলেন, বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের প্ল্যাটফর্ম, একটি বটগাছ। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মানুষ এখানে আসবে বিশ্রাম নেবে, পিপাসা মেটানোর পর আবার চলে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। এদের বেশি গুরুত্ব দেয়ার দরকার মনে করে না বিএনপি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বারবার বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের আগে থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এখন আবার নতুন ষড়যন্ত্রের আভাস শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কোনো কাজ হবে না। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে কিন্তু কোনোভাবেই তা সফল হয়নি।
তিনি বলেন, যারা যাচ্ছেন তারা ক’দিন পর রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের নানামুখী চাপের কারণে কেউ কেউ পদত্যাগপত্র দিচ্ছেন। আমরা এসব পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছি না।
এদিকে পদত্যাগ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ইস্যুতে দলের নীতিনির্ধারকরা কিছুটা বিব্রত হলেও তৃণমূলে এর কোনো প্রভাব নেই। উল্টো অনেকে এতে আরও স্বস্তি প্রকাশ করছেন। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এ পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়েছেন। যারা নিষ্ক্রিয় এবং সুবিধাবাদী তাদের ব্যাপারে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে দলের হাইকমান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কেউ কেউ।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মাহমুদুর রহমান সুমন বলেন, যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের বিষয়ে তৃণমূল ভালো করেই জানে। তারা এ ধরনের মানসিকতা নিয়েই থাকে। এত বড় দলে কেউ চলে গেলে ক্ষতি হবে না। কারণ বিএনপির সমর্থক এখন দ্বিগুণ হয়েছে, নেতাকর্মীর সংখ্যা আরও বেড়েছে। সুতরাং তৃণমূলে এর কোনো প্রভাবই পড়েনি।