করোনা মহামারিতেও নারীর প্রতি উদ্বেগজনক সহিংসতায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জড়িত
করোনা মহামারীতেও দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। নারীর প্রতি নিপীড়ন ও সহিংসতার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে এ চিত্র উঠে এসেছে।
অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারির মধ্যেও এই তিন মাসে ধর্ষণ, নিপীড়ন, যৌন হয়রানি, যৌতুক এবং পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন অনেক নারী। আর এসব ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নারীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন ও সহিংসতা অভিযোগ উঠলেও বিচার এবং অপরাধীদের সাজা হওয়ার সংখ্যা খুবই নগণ্য।
ধর্ষণ:
অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনের ফাঁক গলে ধর্ষকরা রেহাই পেয়ে যাচ্ছে অথবা গ্রেফতার করা হচ্ছে না। ফলে দেশে ব্যাপকভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের বিচার না হওয়ার পেছনে পুলিশের অসহযোগিতা অন্যতম কারণ। অভিযোগ রয়েছে যে, পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে মামলা নিতে চায় না। মামলা করতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক নারী ও শিশু থানায় হেনস্থার শিকার হন। আবার মামলা দায়ের হলেও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে পুলিশ অনীহা প্রকাশ করে।
এই মানবাধিকার সংগঠনটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ধর্ষণের সঙ্গে অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অনীহা এবং দুর্বল মামলার পাশাপাশি পুলিশ নিজেও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে এবং ভিকটিম মামলা করলে তাঁদেরকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেয়া হচ্ছে। সালিশ করে ক্ষমতাসীনদলের নেতারা ধর্ষণের শিকার ভিকটিম পরিবারকে উল্টো জরিমানা করছে। এছাড়া আদালত থেকেও ধর্ষণ মামলার নথি গায়েব হয়ে যাচ্ছে।
দেশের শীর্ষ এ মানবাধিকার সংগঠনটির সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী গত তিন মাসে ৩২২ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ১২১ জন নারী, ১৮৬ জন মেয়ে শিশু এবং ১৫ জনের বয়স জানা যায়নি। ওই ১২১ জন নারীর মধ্যে ৪২ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং দুই জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর একজন নারী আত্মহত্যা করেন। ১৮৬ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৪ জন। এই সময়কালে ৩৮ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে কয়েকটি আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করা করা হয়। এতে বলা হয়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজে এক দম্পতি বেড়াতে গেলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের কর্মী সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে তারেক আহমেদ, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান তাঁদেরকে তুলে কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যায়। এরপর ছাত্রলীগ কর্মীরা স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ ছাত্রলীগের দখলে থাকা ছাত্রবাসে অভিযান চালিয়ে পাইপগান ও চারটি রামদা উদ্ধার করে। এই ঘটনায় পুলিশ সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, অর্জুন লস্কর এবং রবিউল ইসলামসহ দুইজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে খাগড়াছড়ি জেলার শহরতলীতে আট-নয়জন দুবৃর্ত্ত একটি ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠির পরিবারে হামলা চালিয়ে মা-বাবাকে বেঁধে রেখে এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ করে। পুলিশ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে।
যৌন হয়রানি:
যৌন হয়রানি প্রসঙ্গে অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসেও যৌন হয়রানি ব্যাপকভাবে অব্যাহত ছিল। অভিযোগের পর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতির অভিযোগও রয়েছে। বিচার না পেয়ে যৌন হয়রানির শিকার ভিকটিম আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয় মানবাধিকার সংগঠনটির প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, এই সময়ে মোট ৩৫ জন নারী ও মেয়ে শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ০৪ জন আত্মহত্যা করেন, একজনকে হত্যা, নয়জন লাঞ্ছিত, তিনজন আহত এবং ১৮ জন বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসাবে সাতক্ষীরা জেলার একটি ঘটনার কেস স্টাডি উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায় ফেসবুকে অশ্লীল ছবি ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় ক্ষোভে বিউটি মণ্ডল নামে এক তরুণী গত ৯ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা করেন। বিউটির বাবা নিতাই মণ্ডল অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়ের মুখের সঙ্গে বিবস্ত্র একটি ছবি জোড়া লাগিয়ে আপত্তিকর কথা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়। এমনকি ওই ছবিতে তাঁর মেয়ের মোবাইল নম্বার দেয়া হয়। এই ঘটনায় তিনি গত ৭ সেপ্টেম্বর তালা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন এবং শহীদ জিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মৃত্যুঞ্জয় রায় ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু অভিযোগের পরও পুলিশ এই ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই তাঁর মেয়ে ক্ষোভে দুঃখে আত্মহত্যা করে।
যৌতুক সহিংসতা:
অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী যৌতুক দেয়া ও নেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ যৌতুক দেয়া-নেয়ার প্রচলন সমাজে ব্যাপকভাবে এখনো বিদ্যমান রয়েছে। আইনের শাসনের অভাবে অধিকাংশ ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যৌতুক না পাওয়ার কারণে এই তিন মাসে নারীদের পিটিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, শ্বাসরোধ করে এমনকি কুপিয়ে হত্যা করার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটেছে। এসব বিষয়ে পুলিশ অনেক সময় ভিকটিম পরিবারের মামলা নিতে চায় না।
গত তিন মাসে মোট ৪৫ জন নারী যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যৌতুকের দাবীতে পারিবারিক সহিংসতায় ৩ মাসে ১৭ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। ২৮ জন বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
গত ১০ জুলাই ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দায় খোদেজা আক্তার সুমি নামে এক গৃহবধূকে দাবিকৃত যৌতুকের টাকা না পেয়ে তাঁর স্বামী বিল্লাল হোসেন তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় সুমিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হলে ১৫ জুলাই তিনি মারা যান। পুলিশ বিল্লাল হোসেন ও তার মা কুলসুম বেগমকে গ্রেফতার করেছে।
এসিড সহিংসতা:
২০০২ সালের এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন এবং এসিড অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ না করার কারণে ভয়াবহ এসিড সহিংসতা অব্যাহত আছে বলেও অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে নয়জন ব্যাক্তি এসিডদগ্ধ হয়েছেন। এঁদের মধ্যে চারজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী, তিনজন মেয়েশিশু এবং দুইজন পুরুষ রয়েছেন।
গত ১১ আগস্ট রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় নিজ বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় সুমা খাতুন (১৫) নামে এক মাদ্রাসা ছাত্রীর ওপর এসিড ছুঁড়ে মারে অজ্ঞাত দুবৃর্ত্তরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
নারীর প্রতি সহিংসতার এই ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়লে তথাকথিত নারীবাদী সংগঠন গুলো মুখে কুলুপ এঁটে বসেছেন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে কারণে, অকারণে সরব দেখা গেছে। কিন্তু,সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে নারীবাদি সংগঠন গুলো নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনা হলেও নীরব রয়েছেন।
সূত্রঃ আমারদেশ