সরকারি কেনাকাটায় শুধুই অনিয়ম
সরকারি কেনাকাটায় কিছুতেই দুর্নীতি থামানো যাচ্ছে না। সুযোগ পেলেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতরের কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা সমানতালে দুর্নীতি করছেন পণ্য কেনাকাটায়। কোনো রকম নিয়ম না মেনে কিংবা নিয়মের ফাঁকফোকর গলিয়ে তারা নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে বাজার মূল্যের চেয়ে উচ্চ মূল্যে কেনাকাটা করে নিজেদের পকেট ভারী করেন। এতে সরকারের বড় অংকের আর্থিক লোকসান হয়। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দফতরের কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়া, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক তথ্য প্রমাণ পাওয়া এবং কেনাকাটায় সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার পরও কেনাকাটায় দুর্নীতি থামছে না।
সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত সর্বোচ্চ কর্মকর্তা যদি নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে কেনাকাটায় দুর্নীতি থামানো কঠিন। সরকারি কেনাকাটার ব্যাপারে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন (পিপিআর) ও বিধিমালা রয়েছে। এটি অনুসরণ করলে কোনোভাবেই দুর্নীতি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা তা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে বরং তারা কীভাবে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি করা যায় সেদিকটি বেশি খুঁজতে থাকেন।বিশিষ্টজনরা বলছেন, সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার মূল কারণ পিপিআর অনুসরণ না করা। দরপত্রের ক্ষেত্রে ই-জিপি চালু করলেও সেখানে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এ কারণে কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সরকারি কেনাকাটা আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি। যারা পিপিআর ভঙ্গ করেন তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সাবেক মুখ্য সচিব আবদুল করিম বলেন, সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ই-জিপির প্রবর্তন করা হলেও সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি কমেনি। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’
সরকারের স্বাস্থ্য, উন্নয়ন খাত, পূর্ত, রেলওয়ে, বিমান, সিভিল এভিয়েশন, শিক্ষা খাত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, সেবা খাতসহ সরকারি প্রায় সব মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতর সব জায়গায়ই কেনাকাটায় দুর্নীতির খবর পাওয়া যায় কমবেশি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোর নিজস্ব তদন্তেও এসব দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। দুদকও তদন্ত করছে। সর্বশেষ করোনাকালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সুরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটা নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা। যেখানে রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকার পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) তৈরি করেছে। এটি অনুসরণ করেই কেনাকাটা করার কথা। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রণালয়, দফতর বা সংস্থা কেনাকাটার ক্ষেত্রে পিপিআর অনুসরণ করে না। কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা নিজেদের পছন্দের ও ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের দিয়ে কেনাকাটা করান, যাতে উভয়পক্ষ আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। আর জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক কেনাকাটা হলে তো পোয়াবারো অবস্থা। যিনি বা যারা কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত থাকেন তারা যেন হাতে আসমান পান। কারণ ওই সময়ে কোনো রকম দরপত্র আহ্বান করতে হয় না। নিজেদের লোকজনদের দিয়েই তারা কেনাকাটা করান। এতে দুর্নীতি করাটাও সহজ হয়। এই সুযোগটা নিয়েছেন রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। করোনাকালে সুরক্ষা সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, থার্মোমিটার, জীবাণুনাশক টানেল, সাবান, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ এ ধরনের সামগ্রী তাৎক্ষণিক কিনতে গিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারকে দায়িত্ব দিয়েছেন, যারা কিনা কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ। এতে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা আট টাকার গ্লাভস কিনেছেন ৩২ টাকায়। আবার ১৩০ টাকার হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনেছেন ৩৮৪ টাকায়। ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় প্লাস্টিকের চশমা বাজারে পাওয়া যায়, সেটি কেনা হয়েছে প্রতিটি ৩৯৭ টাকা করে। এভাবেই তারা প্রত্যেকটি জিনিস কিনেছেন বাজার মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে।
বিষয়টি জানাজানির পর রেলপথ মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে একজন যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে। ওই কমিটি কেনাকাটায় দুর্নীতির সত্যতাও পেয়েছে। একই সঙ্গে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় সরঞ্জাম কর্তৃপক্ষের প্রধান রুহুল কাদের আজাদসহ ২৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করে ভবিষ্যতে তাদের এ ধরনের কেনাকাটায় সম্পৃক্ত না করার সুপারিশ করেছে।
শুধু রেলওয়ে নয়, এর আগে গত বছর রূপপুর প্রকল্পের বালিশ কেলেঙ্কারির ঘটনাও ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। সেখানে একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে বালিশের দাম ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা, আর আর সেই বালিশ ফ্ল্যাটে উঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা দেখানো হয়েছে। বিষয়টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুই কমিটির তদন্তেই ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকার অনিয়মের কথা উঠে আসে। হাই কোর্টের নির্দেশে আদালতে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্নীতির জন্য ৩৪ জন প্রকৌশলীকে দায়ী করা হয়। দুদকও এ ঘটনা অনুসন্ধান করে। দুদকের অভিযোগে বলা হয়, পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান ও অন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী অস্বাভাবিক দামে কিনে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেনাকাটায়ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে গত বছর। একটি পর্দা কিনতে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। একই সঙ্গে মেডিকেলের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায়ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। আলোচিত এই পর্দা কেলেঙ্কারি ও যন্ত্রপাতি কেনার ঘটনায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের সাবেক দুই প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী ও ডা. গণপতি বিশ্বাসকে বরখাস্ত করা হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর। শুধু তাই নয়, পর্দা ও যন্ত্রপাতি কেনায় ১০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুদক গত বছর ২৭ নভেম্বর মামলা করে।