নিরাময় কেন্দ্রে জমজমাট মাদকের হাট!
বেশিরভাগ মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলো রোগীকে মাদকমুক্ত করার পরিবর্তে উল্টো জমজমাট মাদক ব্যবসা করছে। সেখানে ইয়াবা থেকে শুরু করে সব ধরনের মাদকের ছড়াছড়ি। নিরাময় কেন্দ্রে মাদক পাওয়াটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মূলত এ পারসেপশনটা (ধারণা) কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন থেকে রীতিমতো মাদক বিক্রির আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর অনেক মাদক নিরাময় কেন্দ্র। লাখ নয়, কোথাও কোটি কোটি টাকার মাদক বাণিজ্য হচ্ছে। খরিদ্দার স্থানীয় বখাটে যুবক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণির মানুষ। সব জানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মাঠপর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। কিন্তু নিয়মিত মাসোহারায় সব জায়েজ। অন্যদের ম্যানেজ করতে স্থানীয় মাস্তানদের দেয়া হয় নানা সুবিধা। এলাকার ‘বড় ভাই’খ্যাত প্রভাবশালীদের খুঁটির জোরে এগুলো চলছে বহাল তবিয়তে।
চাঞ্চল্যকর এসব ঘটনার তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে প্রতিবেদকের সরেজমিন অনুসন্ধানে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অদিফতরের পরিদর্শন টিমের সঙ্গে যুক্ত হয় অনুসন্ধান সেল। দিনভর এ অভিযানে একাধিক মাদক নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে গা শিউরে ওঠার মতো অবিশ্বাস্য সব তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, অনুমোদন নিয়েছে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের। অথচ সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে মানসিক হাসপাতালের। ১০ বেডের অনুমতি নিয়ে রোগী ভর্তি করছে অর্ধশতাধিক, পারলে আরও বেশি। নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই, এখানে-সেখানে পড়ে আছে রোগী। অভিযানের তথ্য ফাঁস হওয়ার পরও তারা তড়িঘড়ি করে সবকিছু গোছগাছ করে উঠতে পারেনি। তাতেও যা দেখা গেছে, সবই ছিল ফৌজদারি অপরাধের আলামত। এছাড়া এসব কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক নিয়োগের নামে এক রকম নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ডাক্তার আছে সব খাতা-কলমে। বাস্তবে আসলে নিয়ম মেনে ডাক্তার-নার্স কিছুই নেই। কিছু অখ্যাত ডাক্তার ভাড়া খাটছে পালা করে সব মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। কেউ কেউ পর্দার আড়ালে এসব হাসপাতালের প্রধান ক্রীড়নক। ওষুধ-পথ্য বলতেও তেমন কিছু নেই। কোথাও দেখা গেছে, লোক দেখানোর জন্য ওষুধের খালি প্যাকেট সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
আদাবরে মাইন্ড এইড নামের নিরাময় কেন্দ্রে পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর দেশজুড়ে নিরাময় কেন্দ্রগুলো ঝটিকা পরিদর্শন শুরু করেছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ১৩ নভেম্বর থেকে এ অভিযান শুরু হয়েছে।
শুক্রবার বেলা ২টা ৪১ মিনিট। নিউ ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, গোলারটেক, পালপাড়া মিরপুর। চারতলা জরাজীর্ণ ভবন। ভেতরে ঢুকতেই নিচ তলায় ছোট একটি অফিসকক্ষ। নির্বাহী পরিচালক আকরাম হোসেন তালুকদার আরাম করে ধূমপান করছেন। হঠাৎ আগন্তুক দেখে হতচকিত হয়ে গেলেন। বললেন, আপনারা কে? মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে এসেছি। আমার নাম উপ-পরিচালক হামিমুর রশিদ। ধড়মড় করে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন আকরাম। বললেন বসেন স্যার। বেয়াদবি নেবেন না। ঠাণ্ডা খান স্যার, আনি…। ওসব লাগবে না, কাগজপত্র দেখান।
দু’জন কর্মচারী ছোটাছুটি শুরু করলেন। এখানে-ওখানে কাগজপত্রের সন্ধান করতে লাগলেন। বুক সেলফের র্যাকে, ড্রয়ারে, টেবিলের নিচে খোঁজ চলছে। কিছুক্ষণ পর একজন একটা ফাইল টেবিলে এনে রাখলেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা পরীক্ষা করে দেখেন লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ। প্রশ্ন করা হয়, নবায়ন করেননি কেন? নির্বাহী পরিচালক বলেন, ইয়ে… মানে করোনার জন্য… তবে করে নেব স্যার। এখানে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক আছে? জী আছে। ডাক্তার কই তাকে ডাকেন। স্যার উনি পারিবারিক অনুষ্ঠানে একটু বাইরে গেছেন। এক্ষুণি চলে আসবেন।
নির্বাহী পরিচালক দাবি করেন, এখানে সার্বক্ষণিক ডাক্তার-নার্স সবই আছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক কাউকে পাওয়া গেল না। ওষুধের শোকেসে শুধু খালি বক্স সাজিয়ে রাখা। সেকুলুর রহমান নামের একজন ডাক্তার আছেন জানানো হল। কিন্তু সেকুলুর রহমানের ভিজিটিং কার্ডে লেখা শিশু এবং ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় অভিজ্ঞ। এছাড়া ১০ বেডের নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলেও রোগী পাওয়া গেল অন্তত ৪০ জন। বেশিরভাগই ইয়াবা আসক্ত তরুণ রোগী। নিরাময় কেন্দ্রটি ২০১৮ সালে লাইসেন্স পায়। ২০১৯ সালের পর নবায়ন করা হয়নি। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্স এবং ফায়ার সনদও মেয়াদ উত্তীর্ণ পাওয়া যায়। এ নিরাময় কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক আকরাম হোসেন তালুকদার নিজেও মাদকাসক্ত ছিলেন। এখন নিজেকে সুস্থ এবং মাদকমুক্ত বলে দাবি করেন। রোগীদের পুনর্বাসনের কি ব্যবস্থা আছে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না তিনি। নিরাময় কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা যায়, নিচ তলা এবং দোতলা রোগীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। দোতলায় অপরিচ্ছন্ন প্রায় অন্ধকার ছোট একটি ঘরে ১৫-২০ জন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছেন। একদিকের মেঝেতে উপুড় হয়ে একজন শুয়ে। দুটি দলে ভাগ হয়ে ৮ জন রোগী মেঝেতে বসে লুডু খেলছেন। কক্ষটি দুর্গন্ধময়। একদিকে রোগীদের ব্যবহৃত ময়লা কাপড়-চোপড় স্তূপ করে রাখা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে বেশ কয়েকজন যুবক নির্যাতন চালানোর জন্য বাউন্সার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে শুভ, আল আমিন ও কবির অন্যতম। পরিদর্শন চলাকালে সন্ধ্যা ৬টার দিকে সাদা পাঞ্জাবি পরে ঘটনাস্থলে হাজির হন স্থানীয় এক যুবক। নাম মিয়া মো. মাকসুদ। স্থানীয় এমপি আসলামুল হকের মামা হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘এ কেন্দ্র ভালো চলছে। মহল্লার লোক হিসেবে আমরা এটার দেখভাল করি।’
এরপর উত্তর বিশিল এলাকার ৭ নম্বর রোডের ৫৯/ক প্লটে অবস্থিত ব্রাদার্স মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে আরও ভয়াবহ অবস্থা দেখা যায়। নিরাময় কেন্দ্রটির নিচ তলায় গার্মেন্ট কারখানা। চেয়ারম্যানের নাম মনির হোসেন। কিন্তু তিনি ভিজিটিং কার্ডে লিখেছেন ব্রাদার্স মানব কল্যাণ সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠানেরও লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ। চেয়ারম্যানের হাতে ৬০ হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন। অথচ তিনি বললেন, টাকার অভাবে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেননি। এখানেও ডাক্তার বা নার্সের দেখা মেলেনি। তবে যথারীতি নিরাময় কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টদের দাবি, সবই আছে তাদের। ব্রাদার হিসেবে ইকবাল হোসেন নামের এক যুবককে পাওয়া গেল। কিন্তু তার ব্রাদার হিসেবে কোনো নার্সিং প্রশিক্ষণ নেই। ইকবাল নিজেও আগে মাদক সেবন করতেন। এখন রিকভারি এডিক্ট হিসেবে এখানে চাকরি করছেন। প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টরা জানান, ১০ বেডের লাইসেন্সপ্রাপ্ত কেন্দ্রটি রোগীদের কাছ থেকে গড়ে ৪ হাজার টাকা করে মাসে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। কিন্তু দেখা যায়, কেন্দ্রে প্রায় ১২ জন স্টাফ, ফ্লোর ভাড়া ও রোগীদের থাকা-খাওয়া খরচ মিলিয়ে প্রতি মাসে অন্তত ২ লাখ টাকা খরচ হয়। বাকি টাকা কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মনির হোসেন দাবি করেন সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভর্তুকি দিয়ে তারা এ কেন্দ্র পরিচালনা করছেন।
তবে নারকোটিক্সের পরিদর্শন দলের সদস্যরা গোপন সূত্রে জানতে পারেন, কেন্দ্রটিতে মাদক বিক্রি করা হয়। এছাড়া রোগীদের মারধর নিয়মিত ঘটনা। কেন্দ্রের কর্মচারী রিপন, আমির, সিরাজ, সাইফুল, ফয়সাল এবং মনির চেয়ারম্যান নিজে রোগীদের ওপর নির্যাতন চালান। অনেক রোগীর পরিবারকে রাত-বিরাতে ফোন করে বলা হয় ‘আপনার রোগীর অবস্থা খারাপ, বিকাশে টাকা পাঠান। চিকিৎসা করতে হবে।’ কেন্দ্রের মালিক তিনজন। একজনের নাম টুটুল মিজি, ফয়সাল হোসেন ও মনির হোসেন। এরা সবাই কোটিপতি। সবাই দামি গাড়িতে চড়েন, মিরপুরে একেকজন ২-৩টি করে ফ্ল্যাটও কিনেছেন।
সূত্র জানায়, ব্রাদার্স নিরাময় কেন্দ্রে অবৈধভাবে মানসিক রোগেরও চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু পরিদর্শনের কথা শুনে মানসিক রোগীদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ভেতরে অনেক সিসি ক্যামেরা থাকলেও সম্প্রতি সব রেকর্ড মুছে ফেলা হয়েছে। এখান থেকে নারকোটিক্সের বেশ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোহারাও নেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে চেয়ারম্যান বলেন, মাদক ব্যবসার অভিযোগ সঠিক নয়। এখান থেকে অনেক রোগী নেশামুক্ত হয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক মনির হোসেন জানান, তিনি নিজেও এক সময় মাদক সেবন করতেন। ৫ বছর হল তিনি পুরোপুরি সুস্থ।
রাজধানীতে এমন নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ১০৫টি। সারা দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিরাময় কেন্দ্র ৩৫২টি। এগুলো বৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এরপর বাইরে লাইসেন্সবিহীনভাবে চলছে প্রায় দেড় হাজার। যেগুলোতে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হলেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেউ।