ফের ক্ষমতায় আসছে সু চির দল

0

সেনা শাসন থেকে বেরিয়ে ২০১১ সালে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় মিয়ানমারে। গত রবিবার দেশটিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) সংখ্যাগরিষ্ঠ জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসছে আবারও।

এখনো সরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণা না করা হলেও মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) দেশটির সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার দাবি করেছে। গতকাল সোমবার দলটি বলছে, পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য পার্লামেন্টের বেশিরভাগ আসনে জয় পেয়েছে তারা। বেসরকারি ফলাফলে এনএলডি এগিয়ে রয়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো আভাস দিয়েছে।

এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে সু চির দলের আবার ক্ষমতায় যাওয়া এবং মিয়ানমারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সরকারপক্ষ সু চির দলের আবার জয়ের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সরকার আশা করছে, করোনার কারণে গত আট মাস ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং এ নিয়ে আলোচনা বন্ধ ছিল। তারা আরও মনে করে, এখানে শুধু করোনার বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আটকে দিয়েছিল। নির্বাচনে জয়ের কৌশল হিসেবে সু চি নিজেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি কাজে লাগিয়েছেন। তিনি হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ অস্বীকার করে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। তাই সরকারপক্ষ ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ব্যাপক আকারে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা না থাকলেও নতুন সরকারের সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আবার আলোচনা শুরু হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন গতকাল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শিগগির শুরু হবে এমন আশার কথা বলেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে জয়ী মিয়ানমারের নতুন সরকারকে স্বাগত জানাবে বাংলাদেশ। গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানান, আগেই অনুমান করা হচ্ছিল যে এবার বেশি ভোটে জিতবে সু চির দল। তিনি বলেন, আমরা নতুন সরকারকে স্বাগত জানাব। মিয়ানমারের ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

ড. মোমেন আরও বলেন, ‘চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে আশ্বস্ত করেছেন নির্বাচনের পর প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার আলোচনা শুরু করবে। আমরা আলোচনার ব্যাপারে আশায় আছি। চীনের মধ্যস্থতায় আমরা আলোচনা শুরু করব।’ তিনি বলেন, তাছাড়া মিয়ানমার বিভিন্নভাবে আমাদের কাছে অঙ্গীকার করেছিল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। তারা (মিয়ানমার) আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাখাইনে কী কী পদক্ষেপ তারা নিয়েছে, এ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করবে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের এটি দেওয়া হবে। এটি সুখবর। আমরা এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এ বছরের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আর কোনো আলোচনায় বসেনি মিয়ানমার সরকার। অবশ্য বাংলাদেশ আশা করছে, নির্বাচনের শেষে চীনের মধ্যস্থতায় প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার আবার আলোচনা শুরু করবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার যে সংকট, সেটা কাটাতে আমরা মিয়ানমারকে আসিয়ানের সদস্য দেশ, ভারত ও চীন এদের যুক্ত করে বেসামরিক পর্যবেক্ষকদের দল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। যাতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। আমাদের এ প্রস্তাবে মিয়ানমার হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। আরেকটি প্রস্তাবও দিয়েছি। যেটা মূলত ইন্দোনেশিয়া প্রথম দিয়েছিল। রোহিঙ্গাদের দলনেতা, যারা মাঝি হিসেবে পরিচিত, তাদের দল বেঁধে রাখাইনে নিয়ে গিয়ে দেখাক যে কী কী কাজ রাখাইনে হয়েছে। ফিরে এসে তারা জানাবে কী কী কাজ হয়েছে। আবার চীনের একটি প্রস্তাব ছিল। প্রস্তাবটা এমন রোহিঙ্গাদের যে প্রতিনিধিদল রাখাইনে যাবে তাদের প্রত্যেককে একটি এবং কক্সবাজারে অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের আরেকটি মুঠোফোন দেবে। রাখাইনে যাওয়ার পর সেখান থেকে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা কক্সবাজারে পরিবারের সদস্যদের জানাবে কী দেখেছে। এসব প্রস্তাবের কোনোটিতেই মিয়ানমার হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি।

এনএলডির মুখপাত্র মিও নিন্ত বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি পার্লামেন্টে ৩২২ আসনে জয় পেয়েছে। যদিও দেশটির নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেনি। তিনি বলেন, আমরা জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। জনগণের জন্য, দলের জন্য এটি উৎসাহজনক নির্বাচনী ফল। সোমবার আরও পরের দিকে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের ফল ঘোষণার কথা রয়েছে। রবিবারের নির্বাচনকে দেশটির নেত্রী অং সান সু চির এনএলডি নেতৃত্বাধীন নব্য-গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি গণভোট হিসেবে দেখা হচ্ছে।

দেশটিতে নির্বাচন ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যার অভিযোগে জর্জরিত মিয়ানমারের সরকারের ভাবমূর্তি বিশ্ব পরিমণ্ডলে তলানিতে ঠেকেছে।

মিয়ানমারের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ৪২৫ ও উচ্চকক্ষে ১৬১ আসন রয়েছে। ৫০ বছরের বেশি সময়ের সেনাশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ২০১৫ সালে দেশটিতে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সু চির এনএলডি ভূমিধস জয় পায়। ওই বছর দলটি সংসদের মোট ৩৯০ আসনে বিজয়ী হয়। এবারের সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মিও নিন্ত। নির্বাচনের ফলের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি দেশটির সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালি উর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সু চি করবেন না। তিনি রোহিঙ্গা নিপীড়নের পক্ষ নিয়ে একের পর এক নির্বাচনে জয়ী হবেন। চীন, ভারত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়েই রোহিঙ্গা বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে এ দুই প্রভাবশালী দেশ যদি বাংলাদেশের পক্ষে তাকে তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জরুরি হবে। তবে আশার ব্যাপার হলো, চীন যদি মধ্যস্থতা করে তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে। তবে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়টি মাথায় রেখে অবশ্যই মিয়ানমারের নতুন নির্বাচিত সরকারকে আমরা স্বাগত জানাব।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একেবারেই থেমে আছে। এখন করোনার কারণে জয়েন্ট কমিটির বৈঠকও হচ্ছে না। তবে আমরা আশা করছি মিয়ানমারের নতুন নির্বাচনের পর আবার আলোচনা শুরু হবে।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। সম্প্রতি সেনাপ্রধান এক বিরল সাক্ষাৎকারে তার ক্ষমতার কথা উচ্চারণ করেছেন। অভিযোগ করেছেন, বেসামরিক সরকার নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘অগ্রহণযোগ্য ভুল’ করছে। কমান্ডার ইন চিফ মিং অং হ্লায়াং সেনাবাহিনীকে দেশের ‘অভিভাবক’ বলে উল্লেখ করেন।

এদিকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরদিন গত ২ জুলাই ইউইসি ঘোষণা করে, বিদেশে বাস করা মিয়ানমারের নাগরিকরা এ বছরের সাধারণ নির্বাচনে অগ্রিম ভোট দিতে পারবে। ২০১০ ও ’১৫ সালের নির্বাচনেও প্রবাসীদের ভোটদানের ব্যবস্থা করেছিল মিয়ানমার। এর আগে ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু শেষ নির্বাচনে সেই কথা রাখেনি মিয়ানমার সরকার।

জানা গেছে, ১৯৮২ সালে সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরুর আগে যাদের পূর্বপুরুষরা সেখানে ছিলেন, বর্তমানে তারাই শুধু নাগরিকত্ব পাচ্ছেন। এছাড়া দেশটির ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এর মধ্যে নৃগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তখন থেকেই রোহিঙ্গারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের চেষ্টা করছে। এ জাতীয় দাবির কারণেই বারবার তাদের বিতাড়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে দেশটির সরকার।

সর্বশেষ ২০১৬ ও ’১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ওপর দলবদ্ধ ধর্ষণ-গণহত্যা চলাকালে নতুন করে আট লাখেরও বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপরও ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে আছে, তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে দাবি জনগোষ্ঠীর।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com