ধরা পড়লেন এসআই আকবর

0

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবক রায়হান আহমদের (৩৪) মৃত্যুর ঘটনায় আলোচিত বন্দরবাজার ফাঁড়ির বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া অবশেষে নাটকীয়ভাবে ধরা পড়েছেন। ঘটনার এক মাসের মাথায় গতকাল সোমবার দুপুরে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ডোনা সীমান্তে তিনি ধরা পড়েন। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, ভারতে পালানোর সময় স্থানীয়দের সহযোগিতায় আকবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে আকবরের ধরা পড়ার দৃশ্যের কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, পাহাড়ি এলাকায় একদল যুবক আকবরকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আকবর বলেন, ‘সিনিয়র অফিসারের কথায় আমি পালিয়েছিলাম।’

এসআই আকবরকে কানাইঘাটে গ্রেপ্তারের পর গতকাল বিকেলে কড়া পুলিশি পাহারায় সিলেটের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। এ সময় সেখানে বিপুলসংখ্যক উৎসুক মানুষের ভিড় জমে। তারা আকবরের ফাঁসির দাবি করে স্লোগান দেয়। সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে আকবরকে গ্রেপ্তারের বিবরণ দেন।

পুলিশ সুপার বলেন, ‘আকবর কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন এমন তথ্য আমরা পেয়েছিলাম। সেই তথ্যের ভিত্তিতে গত রবিবার থেকে কানাইঘাট সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়। সাদাপোশাকে পুলিশ সেখানে অবস্থান নেয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।’

রায়হানের মৃত্যুর দুদিন পরই এসআই আকবর ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সুপার বলেন, ‘সে আগে ভারতে পালিয়ে গিয়ে থাকলে আবার ফিরে আসতে পারে। ফের পালানোর সময় সীমান্ত এলাকা থেকেই তাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি।’

সিনিয়র অফিসারের কথায় পালিয়েছিলেন বলে দাবি : আকবরকে আটকের দৃশ্যের কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিওতে দেখা যায় পাহাড়ি এলাকায় একদল যুবক আকবরকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। তারা আকবরের সঙ্গে কথা বলছেন। একজন নাম জিজ্ঞেস করলে আটক ব্যক্তি তার নাম আকবর বলে জানান। আরেকজন বলছেন, ‘এই ব্যক্তি বাংলাদেশে রায়হানকে হত্যা করেছে।’ অন্য একজন বলছেন, ‘মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য তুমি একজনকে খুন করেছ।’ এ সময় অন্যরা তাকে মারতে চাইলে বাধা দিয়ে একজন বলছেন, ‘মেরো না, বাংলাদেশেই তার বিচার হবে।’ তখন এসআই আকবর হাতজোড় করে তাকে না মারার আকুতি জানিয়ে বলছেন, ‘রায়হানকে আমি মারিনি। অসুস্থ হওয়ার পর তাকে আমি হাসপাতালে নিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সিনিয়র অফিসারের কথায় আমি পালিয়েছিলাম। ওই অফিসার আমাকে বলেছিলেন, দুই মাস গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তখন তুমি ফিরে এসো।’

এসব কথোপকথন ও ভিডিওর ব্যাপারে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ভিডিও দেখিনি, তবে একটি ভিডিওর কথা শুনেছি। সেটা আমরা দেখব। তবে আকবরকে জেলা পুলিশই সীমান্তের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সহায়তায় গ্রেপ্তার করেছে। আকবর ডোনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাতে পারেন গোপন সূত্রে পাওয়া এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত রবিবার রাত থেকেই সাদাপোশাকে পুলিশ ডোনা সীমান্তে অবস্থান নিয়েছিল।’

ফেইসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, একদল যুবক আকবরের হাত-পা বেঁধে পাহাড়ি ছড়া দিয়ে হেঁটে নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় ওই যুবকরা আকবরকে বিভিন্ন প্রশ্নও করছেন। ওই যুবকরা বাংলায় কথা বললেও তাদের শারীরিক গঠন ও কণ্ঠস্বর ছিল অবাঙালিদের মতো। কানাইঘাট এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ভিডিওতে যে যুবকদের দেখা গেছে, তারা খাসিয়া সম্প্রদায়ের এবং যে জায়গার ছবি দেখা গেছে তা ভারতের অভ্যন্তরের।

এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘একটি ভিডিও ছড়িয়েছে বলে শুনেছি। তবে সেটি এখনো দেখিনি।’

পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যে কেউ আইন অমান্য করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এসআই আকবর জঘন্য কাজ করেছে। তাই তাকেও শাস্তি পেতে হবে।’

গতকাল রাতেই আকবরকে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।

দাড়ি রেখে পুঁতির মালা পরে ছিলেন আকবর : গ্রেপ্তার এড়াতে নিজের বেশভূষা পাল্টে নিয়েছিলেন এসআই আকবর। ইউটিউব চ্যানেলের জন্য নির্মিত একাধিক নাটকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করা সুদর্শন আকবরের বর্তমান রূপ দেখে যে কেউ বিভ্রান্তিতে পড়বেন। মুখে দাড়ি, গলায় পুঁতির মালা। মনে হতে পারে কোনো হাবাগোবা যুবক। গতকাল তিনি ধরা পড়ার যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে তাতে দেখা যায়, রশি তার কোমরে বাঁধা। কান্নার সুরে তিনি বলছেন, ‘আমাকে একজন সিনিয়র অফিসার পালাতে বলেছিলেন। তাই আমি পালিয়েছি। আমি রায়হানকে মারিনি ভাই। আমাকে মেরো না।’ ভিডিওতে দেখা গেছে, আকবরকে নাম জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। এ সময় আকবর বসা ছিলেন। নাম কী? জানতে চাওয়ায় আকবর দুই হাতজোড় করে বলেন, ‘আমি আকবর।’ ‘তুমি আকবর, তুমি তো পালাইয়া আসছ, হত্যা করেছ? এমন প্রশ্নের জবাবে আকবর বলেন, ‘না ভাই, আমি মারিনি। হাসপাতালে নিয়েছি।’ এ সময় সঙ্গে থাকা কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘মাইরও না। এইটা বাংলাদেশি। বিচার করবে তারা।’ আকবর তখন ‘আমি বাঁচব না ভাই’ বলে আহাজারি করছিলেন।

যারা আকবরকে প্রশ্ন করছিলেন, তাদের কথাবার্তা বাংলা হলেও খাসিয়াদের মতো উচ্চারণ ছিল। আকবরের সাজও অনেকটা খাসিয়া যুবকদের মতো। তাকে ঘিরে রাখা যুবকরা তার হাতে পানির বোতল তুলে দিয়ে বলছিলেন, ‘পানি খা।’ এ সময় আকবর বোতল হাতে নিয়ে হেলেদুলে হাঁটছিলেন।

কানাইঘাটের স্থানীয়রা জানান, ডোনা সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। যেখানে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে খাসিয়াদের বসবাস। এই খাসিয়াদের হাতেই হয়তো আকবর ধরা পড়েছেন।

গ্রেপ্তার এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের বেড়তলা বগইর গ্রামের জাফর আলী ভূঁইয়ার ছেলে। আকবর পুলিশে যোগ দেন ২০১৪ সালে। বছরখানেক আগে তিনি সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পান। নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বন্দর ফাঁড়ির দায়িত্ব পেয়ে টাকার নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন আকবর। রাতারাতি টাকার পাহাড়ও গড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার বাড়িতে উঠেছে আলিশান দালান।

গত ১০ অক্টোবর রাতে সিলেট নগরীর আখালিয়ার নেহারিপাড়ার প্রয়াত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান আহমদকে ধরে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। এ সময় পুলিশের মোবাইল ফোন থেকে বাসায় ফোন করে রায়হান বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে গিয়ে তাকে বাঁচাতে। পরে তার চাচা ফাঁড়িতে ছুটে গেলেও পুলিশ জানায়, রায়হান অসুস্থ হওয়ায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেখানে গিয়ে মর্গে রায়হানের লাশ পান পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পিবিআই। পিবিআই দায়িত্ব নেওয়ার পর রায়হানের লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তে তার শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

মামলায় ইতিমধ্যে বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও টিটু চন্দ্র দাস এবং সোর্স সাইদুর শেখকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। এ ছাড়া বন্দরবাজার ফাঁড়ির তিন কনস্টেবল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে রায়হানের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা ও নির্যাতনকারীদের নাম জানিয়েছেন।

ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে বরখাস্তের পর ১২ অক্টোবর গা ঢাকা দেন। এরপর তিনি যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য পিবিআই দেশের সব ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়ে সতর্কতা জারি করে। অবশেষে গতকাল ধরা পড়লেন এসআই আকবর।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com