‘অবৈধপথে’ আসা ফুজির এক্সরে ফিল্মে সয়লাব বাজার
ত্বক ভেদ করে মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ ভাগের ছবি প্রকাশের মাধ্যমে রোগ শনাক্তকরণে এক্সরে এখন পর্যন্ত প্রায় এককভাবে সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এক্সরে পরীক্ষার রিপোর্ট থেকে সমস্যা চিহ্নিত করার পরই শুরু হয় চিকিৎসা। এক্সরে মেশিনের প্লেটে হাড়ের ফাটল কিংবা অসামঞ্জস্যতা নির্ণয়ের ফলাফল ফ্লিল্মের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। এক্সরে ফ্লিল্মের সেই ইমেজ দেখেই চিকিৎসক সঠিক সমস্যাটি নির্ণয় করতে পারেন।
সকল দেশে চিকিৎসা সেবায় এক্সরে মেশিন এবং এক্সরে ফ্লিল্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের এক্সরের কাজে ব্যবহার করা হয় এক্সরে ফ্লিল্ম। এক্সরে ফ্লিল্মের আন্তর্জাতিক বাজারে সব থেকে বেশি চাহিদা জাপানের ফুজি ফ্লিল্মের। বাংলাদেশে বিগত বহু বছর যাবত এই ফ্লিল্মের একমাত্র আমদানিকারক এজেন্ট ও পরিবেশক হচ্ছে জিএমই গ্রুপের ‘গ্রাফিক মেশিনারিজ অ্যান্ড ইক্যুপমেন্ট লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। উচ্চ আদালতের এক নির্দেশনা ( নিষেধাজ্ঞা) অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠান ব্যতীত আর কেউই ফুজি ফ্লিল্মের কোনো পণ্য আমদানি, বাজারজাত বা বিক্রয় ও ব্যবহার করতে পারেন না।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চক্র ফুজি ফ্লিল্মের এই পণ্য ভিন্ন নামে তথ্য গোপন করে এবং সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর অবৈধভাবে নিয়ে আসা এসব ফ্লিল্মের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ যেসব ফ্লিল্ম বাংলাদেশে আনা হচ্ছে সেগুলো ইউরোপের দেশগুলোর তাপানুকূল পরিবেশের জন্য তৈরি করা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর শাহবাগ থানা এলাকার বিএমএ ভবনের বিভিন্ন দোকানের অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধ উপায়ে আসা এসব ফ্লিল্ম বিক্রি করছে বলে জানা গেছে। আর সেখান থেকেই সারা দেশে এসব অবৈধ ফ্লিল্ম ছড়িয়ে পড়ছে।
কাজ হচ্ছে না উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাতেও
২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এসব অভিযোগ উল্লেখ্য করে একটি রিট (নং-৫০৬৮/২০১৭) পিটিশন দাখিল করা হয়েছিল। সেই রিটের শুনানি শেষে বিচারপতিগণ ‘গ্রাফিক মেশিনারিজ অ্যান্ড ইক্যুপমেন্ট লিমিটেড’ ও তাদের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ব্যতিত ফুজি ফ্লিল্মের এক্সরেসহ যে কোনো পণ্য অবৈধ পথে আমদানি বা বাজারজাত ও বিক্রয় করতে পারবে না বলে এক নিষেধাজ্ঞা আদেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে উক্ত নিষেধাজ্ঞা আদেশটি আবারও ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট পুনরায় ছয় মাসের জন্য বর্ধিত করা হয়।
উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনা কেউ অমান্য করলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও প্রকাশ্যেই অনেক অসাধু ব্যবসায়ী তাদের ব্যবস্যা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাধ্য হয়ে থানায় জিডি
আদালতের এমন নির্দেশনার পরেও অবৈধভাবে আনা এসব এক্সরে ফ্লিল্মে বাজার সয়লাব। তাই বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিতে গত ২৮ অক্টোবর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের করা হয়েছে। জিডি নম্বর-১৮৫০।
জিডিতেও বলা হয়েছে, সম্প্রতি কিছু অসাধু চক্র সরকারি ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ফুজি ফ্লিল্ম জাপানির বেনামে অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। ফলে ওই প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরেও বিএমএ ভবনের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধ উপায়ে আসা এসব ফ্লিল্ম বিক্রি করছে। এখান থেকেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
দোষ চাপাচ্ছেন একে অন্যকে
অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিতে বিএমএ ভবনসহ দেশের বেশ কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। অবৈধভাবে আনা এসব ফ্লিল্ম বিক্রির কথা স্বীকার করে অনেক দোকানদার ও বিক্রেতারা একে অন্যকে দোষারোপ করছেন। সবাই বলছেন, তিনি অপর এক জনের কাছে থেকে কিনে তা বিক্রি করছেন। কিন্তু কার কাছে থেকে কিনে তা বিক্রি করছেন; সে ব্যাপারে কেউই স্পষ্ট কোনো উত্তর দিচ্ছেন না।
বিএমএ ভবনের এক দোকানদার দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমি তিনজনের কাছে থেকে ফুজি ফিল্ম কিনে বিক্রি করি। বিদেশ থেকে আনার মতো এত টাকা আমার নেই।’
আরেক সার্জিক্যাল ব্যবস্যায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদেরকে বাইরের একজন দিয়ে যায়। আমরা একটু লাভের জন্য বিক্রি করি। কিন্তু তারা কীভাবে দেশে নিয়ে আসেন সেটা আমরা জানি না।’
নোয়াখালীর মুহিন নামে এক ব্যবসায়ী দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা এসব ফ্লিল্ম বিএমএ ভবন থেকে নিয়ে আসি। অবৈধ নাকি তা সঠিক জানি না, আমার একজন লোক আছে সেই এসব ব্যবস্থা করে।’
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
‘গ্রাফিক মেশিনারিজ অ্যান্ড ইক্যুপমেন্ট লিমিটেড’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহেমদ দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘অবৈধভাবে আনা এসব এক্সরে ফ্লিল্মের কারণে যে শুধুমাত্র আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এমন নয়। এতে সরকারও অনেক টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ঘোষণা ছাড়াই এসব পণ্য নিয়ে আসছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা ক্রয় মূল্য কম দেখিয়েও সরকারি ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে পণ্য আনছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব পণ্য অবৈধভাবে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আনা হচ্ছে। এতে এর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ইউরোপ বা অন্য দেশের জন্য এক রকম ভাবে এই ফ্লিল্ম তৈরি করা হয়। আবার বাংলাদেশের জন্য একভাবে তৈরি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. সেলিম দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘কোয়ালিটির দিক থেকে ফুজির ফ্লিল্ম সব থেকে ভালো। বেশির ভাগ হাসপাতালেই ফুজির মেশিন ও ফ্লিল্ম দিয়ে কাজ করানো হয়। আর ফুজির ফ্লিল্ম কোনটি বৈধপথে আসা বা কোনটি অবৈধপথে আসা সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।’
শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মতিউর রহমান জানান, একটি জিডি দায়ের হয়েছে। বিষয়টি দেখা হচ্ছে।
অপরদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ এ. মু’মেন দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’