বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১৩ বছর: বিচারক বেড়েছে, মামলাজট কমেনি
আজ ১ নভেম্বর। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ২০০৭ সালের এই দিনে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয় বিচার বিভাগকে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের আজ ১৩ বছর পূর্ণ হলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও মামলাজট বেড়েছে। তবে মামলাজট নিরসনে অবকাঠামোগত ব্যবস্থার সঙ্গে প্রয়োজন বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর। কারণ বিচারক সংখ্যা না বাড়লে দেশে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা অসম্ভব। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটে ঐতিহাসিক মাসদার হেসেন মামলার রায়ের আলোকে। সে রায়ের ফলে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হয়।
এরপর থেকে শুরু হয় বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে পথচলা। শুরুতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন না থাকায় বিচারকদের এজলাস ভাগাভাগি করে কাজ করতে হতো। তবে, সময়ের ব্যাবধানে সে অবস্থার অনেকটাই উত্তরণ করতে পেরেছে সরকারের বিচার বিভাগ। কিন্তু লাগামহীন হয়ে পড়েছে মামলাজট।
এ বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলেছে। সেসব অপরাধ দমনে দৃশ্যমান বিচার ব্যবস্থার লক্ষ্যে নিয়ে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। দেশে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে পারলে অপরাধের হার কমে আসবে। আইনের শাসন আরও কার্যকরী হবে। আর এসব কিছুর শুরুতেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেয়া জরুরি হয়ে উঠেছে।’
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য বলছে, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট উভয় বিভাগে মোট বিচারপতি রয়েছেন ১০২ জন। আর দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারকের সংখ্যা এক হাজার ৮০১ জন। অথচ সারাদেশে মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, অধস্তন আদালতে বিচারকদের সংখ্যা এক হাজার ৮০১ জন হলেও আদালতের মূল বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে আছেন প্রায় এক হাজার ৪০০ জন বিচারক। আর অবশিষ্ট বিচারকরা সুপ্রিম কোর্ট, আইন মন্ত্রণালয়, ট্রাইব্যুনাল, আইন কমিশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ডেপুটেশনে (পদায়ন) কর্মরত রয়েছেন। ফলে বিচারকদের কৃত্রিম সংকট মামলাজট নিরসনে ডেকে এনেছে বিপর্যয়।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘মামলাজট নিরসনে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। আমরা মামলাজট নিরসন, আদালতের অনিয়ম বন্ধ ও বিচারক নিয়োগসহ সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব এবং জনগণের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করব।’
তিনি বলেন, জনগণের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছে দেয়া না গেলে তার পরিণতি কী হবে সেটা মুখে উচ্চারণ করাও উচিত নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা মনে করেন, বিচার বিভাগে মামলাজট নিরসন করা না গেলে আদালত অঙ্গনের অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলো রোধ করা সম্ভব হবে না। আবার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলেও মামলাজট নিরসন জরুরি।
তারা বলছেন, হাজার হাজার মামলার ভিড়ে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে একধরনের চক্র গড়ে উঠেছে। এসব অবস্থা থেকে পরিত্রাণ খুঁজতে হলেও সারাদেশে বিচারক নিয়োগের হার বৃদ্ধি করতে হবে। এমনকি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।
নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর মামলাজট নিরসনকে প্রধান চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামলাজট নিরসন করাটাই আমার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে এই জট নিরসনে ব্যক্তিগত কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। পাশাপাশি বিচারক নিয়োগসহ আরও কিছু বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে শিগগিরই আলোচনা করব।’
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা-সংক্রান্ত মাসদার হোসেন বনাম সরকার মামলার যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেন সর্বোচ্চ আদালত।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে ৩০১ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা নিয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।