আইনের দুর্বলতার সুযোগে ওষুধের দাম চারগুণ

0

করোনাকালেও দেশে জীবনরক্ষাকারীসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দাম সর্বোচ্চ চারগুণ বেড়েছে। সরকার নির্ধারণ করে দেয়ার পরও কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুইগুণ।

ভিটামিনজাতীয় ওষুধের দাম তিন থেকে চারগুণ, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগ ওষুধের দাম দেড় থেকে দ্বিগুণ বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে সর্দিজ্বর, মাথাব্যথা, কাশির ওষুধের দাম। বাদ যায়নি অ্যান্টিবায়োটিক ও রক্তচলাচল স্বাভাবিক করার ওষুধও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাকে পুঁজি করে ওষুধের দাম বাড়িয়েছে দেশি-বিদেশি উৎপাদকরা। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন ওষুধ বেশি দামে বিক্রিতে পিছিয়ে নেই খুচরা বিক্রেতারাও। বিশেষ করে, করোনার প্রতিষেধক হিসেবে যে ওষুধের নাম এসছে, সেগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছে ইচ্ছামতো। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও সাধারণ অনেক ওষুধ বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ-চারগুণ দামে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ রোগীরা।

তবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের দাবি, কোম্পানিগুলো দাম কিছুটা বাড়িয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের তৎপরতায় এখন তা অনেকটাই স্বাভাবিক। দেশে যেন ওষুধের দাম ও প্রাপ্যতা স্বাভাবিক থাকে, সেজন্য জানুয়ারি থেকেই ওষুধ উৎপাদকদের সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনা প্রদুর্ভাবের শুরুর দিকে কিছু ওষুধের দাম বেশি ছিল। তবে সার্বিকভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল।

তিনি বলেন, করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ফেবিপেরাভিন ৪০০ টাকায় বিক্রি হতো। আমরা এটার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি ২০০ টাকা। রেমডিসিভির বিক্রি হতো ৫ হাজার ৬০০ টাকায়, এটার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার টাকা এবং আইভারমেকটিন প্রতি ট্যাবলেট ১০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ওষুধের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমরা ২৮ জানুয়ারি উৎপাদকদের সঙ্গে বৈঠক করি। তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দিই। ফলে দেশে ওষুধের কোনো ঘাটতি হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে রেমডিসিভির। ঔষধ প্রশাসন এর দাম ৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকায়। এছাড়া করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ফেভিপেরাভিনের নির্ধারিত মূল্য ২০০ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। আইভারম্যাকটিনের একটি ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ৫০ টাকা। যদিও এর নির্ধারিত দাম ১০ টাকা।

করোনা-আক্রান্ত্র রোগীদের শরীরের দুর্বলতা কাটাতে চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেই কারণে বেড়েছে ভিটামিনের দাম।

বাজারে এক পাতা সি-ভিটের দাম ১০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এক ফাইল নিউরো-বি ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা, নিউরোক্যাল ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা। এক পাতা জিঙ্ক ট্যাবলেট বিক্রি হতো ৩০ টাকা, এখন বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। হৃদরোগী ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। সেজন্য হৃদরোগের ওষুধ রসুভাস-১০ এর দাম ১৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা, রসুভাস-৫ এর দাম ৮০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০০ টাকা, টোসার ৪০ থেকে ৫০ টাকা। শ্বাসকষ্টের ওষুধ ডক্সিসাইক্লিন, ডক্সিক্যাপ প্রতি পাতার দাম ২০ টাকা হলেও নেয়া হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা।

বর্তমানে এই ওষুধটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ ফার্মেসিতে ডক্সিসাইক্লিন গ্রুপের ওষুধ নেই বললেই চলে। কাশির ওষুধ অ্যাডোভাস সিরাপের দাম ৫৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৫ টাকা। অ্যজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের দাম দ্বিগুণ বেড়ে ৩১৫ টাকার স্থালে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। এমনকি মুমূর্ষু রোগীদের রক্তচলাচল ঠিক রাখতে ওরাডক্সান গ্রুপের ইনজেকশন ভায়ল ৩০ টাকার পরিবর্তে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা।

তেজগাঁওয়ের এক ওষুধের দোকানি যুগান্তরকে বলেন, আগে এক বক্স ভিটামিন-সি বিক্রি হতো ৪৭২ টাকায়। এখন তা ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে ৩৬০ টাকার রিকোনিল ২০০ এমজি ৬০০ টাকা, ৪৮০ টাকার মোনাস ১০ এমজি ট্যাবলেট ১০০০ টাকা, ৩১৫ টাকার অ্যাজিথ্রোমাইসিন ৫০০ এমজি ট্যাবলেট ৬০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া প্যারাসিটামল, নাপা, নাপা এক্সট্রা- ৫০০ এমজির এক পাতা আগে ছিল ৮ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা। ফেক্সোফেনাডিল গ্রুপের ওষুধের আগের দাম ৭৫ টাকা হলেও এখন নেয়া হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। মনটিন ১০ এমজি এক পাতা ২১০ থেকে নেয়া হচ্ছে ২৩০ টাকা। মনাস ১০ এমজি প্রতি বক্স ৪১৫ টাকার জায়গায় বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনার শুরুতে ওষুধসহ জীবনরক্ষাকারী পণ্যের ব্যপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। এপ্রিল থেকে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের চাহিদা দেখা দেয়। এ সময় নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক মানুষ ঘরে ঘরে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ মজুদ করতে শুরু করে। এ সুযোগকে পুঁজি করে উৎপাদক ও দোকানিরা কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত মুনাফায় নেমে পড়ে।

অপর একটি সূত্র যুগান্তরকে জানায়, আসছে ডিসেম্বরে শ্বাসকষ্ট ও ঠাণ্ডাজনিত ওষুধের চাহিদা বাড়বে। সেই উপলক্ষে আগে থেকেই দেশের বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো এসব ওষুধের সংকট তৈরি করেছে। একই সঙ্গে এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনেও সমস্যা রয়েছে। ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ এখনও কার্যকর থাকায় এর সুযোগ নেয় কোম্পানিগুলো। এই আইন বলে তারা নিজেরাই ওষুধের দাম নির্ধারণ করে।

রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট, গ্রিনরোড ও তেজগাঁও এলাকার একাধিক ওষুধের দোকানে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ ওষুধের দাম নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি রাখা হচ্ছে। কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে চাহিদা বেশি থাকায় ওষুধ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে।

তাদের মতে, করোনার সময়ে স্কাভো-৬, ইভেরা-১২, প্যারাসিটামল, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, অ্যান্টিহিস্টাসিন, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল এবং ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ডি ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধের বিক্রি কয়েক গুণ বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। আর এই সংকটের কারণে দামও বেড়েছে।

দাম বাড়ানোর বিষয়ে দোকানিদের অভিযোগ, তারা ওষুধের সরবরাহই পাচ্ছেন কম। উৎপাদকরা দাম বাড়িয়েছে বলেই তারা বেশি দামে বিক্রি করছে। বাংলাদেশ ক্যামিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক মো. আবদুল হাই বলেন, কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়ালে দোনকানিদের কিছু করার থাকে না।

এখন ওষুধের দাম ঠিক করে কোম্পানি। পরে শুধু ভ্যাট নির্ধারণের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে পাঠায়। তাই দাম নির্ধারণে ওষুধ প্রশাসনের কিছু করার থাকে না। তাছাড়া এক কোম্পানি দাম বাড়ালে অন্যরাও বাড়িয়ে দেয়।

ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শফিউজ্জামান বলেন, ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। এক্ষেত্রে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি।

করোনার ওষুধ শুনেই মানুষ নানা ধরনের ওষুধ কিনে বাসায় রাখতে শুরু করে। ফলে কিছু ওষুধের সংকট তৈরি হয়। এই সুযোগে দোকানিরা দাম বেশি নিতে পারে। তবে আমরা ওষুধের দাম বাড়াইনি।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com