চীন থেকে বাংলাদেশকে দূরে রাখতে ‘প্রতিরক্ষা কূটনীতি’ ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তৃত করেছে চীন। এ সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ‘উদীয়মান’ মিত্রের মন জয় করতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে নিজেদের সামরিক হার্ডওয়্যার বা অস্ত্র অধিকহারে কিনতে বাংলাদেশকে প্রলুব্ধ করতে তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিরল এক ঘটনায় এ মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও দেখাশোনা করেন, তাকে ফোন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার। ওই ফোনে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিকে ২০৩০ সালের মধ্যে সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নে সহায়তার প্রস্তাব দেন। অনলাইন নিক্কি এশিয়ান রিভিউয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, অ্যাপাচে হেলিকপ্টার ও ক্ষেপণাস্ত্রসহ আধুনিক সামরিক অস্ত্র বিক্রি নিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় গত বছরে। যদিও বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি এ নিয়ে, তবু ধারণা করা হয় একটি চুক্তির পর্যায়ে রয়েছে তা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি এসিসট্যান্ট সেক্রেটারি লরা স্টোন বলেছেন, ‘বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসকে জানানো হয়নি’।
বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন কোনোও চুক্তি করে তাতে হতাশ হবে চীন। কারণ, বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে সস্তায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী দেশ হলো তারা।
নিক্কি এশিয়ান রিভিউয়ের সাম্প্রতিক এক ইমেইলের জবাব দিয়েছেন লরা স্টোন। তাতে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা আরো গভীর করতে চাই। এই সহযোগিতা পারস্পরিক স্বার্থে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ সম্মান দেখানো হবে। বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করতে অংশীদার হিসেবে আমরা প্রস্তুত। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ডেস্কে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান এবং মালদ্বীপ ইস্যু দেখাশোনা করেন লরা স্টোন।
নিক্কি এশিয়ান রিভিউ আরো লিখেছে, ১৯৯০ এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিক পরিমাণ অস্ত্র কিনেছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সাল নাগাদ ১০ বছরে ১১ কোটি ডলারের অস্ত্র কেনা হয়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে চীনের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে ২৫৯ কোটি ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে চীনের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র কেনার অংকটি নস্যি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, ঢাকা যখন বেইজিংয়ের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ফোনালাপের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাণিজ্য ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের বাইরেও বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করেছে চীন। করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে সরবরাহ পাঠিয়েছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে মাস্ক ও গাউন। তারা করোনা মহামারিতে কি কি করতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে একটি মেডিকেল টিম। উপরন্তু চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাক বায়োটেক উদ্ভাবিত করোনার একটি টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা প্রক্রিয়া অগ্রসরমান।
ভারত সীমান্তঘোঁষা উত্তরপূর্বের শহর সিলেটে বিমানবন্দরে ২৫ কোটি ডলারের টার্মিনাল নির্মাণকাজ নিশ্চিত করেছে চীন। এরপরই বাংলাদেশে আমদানিপণ্যের শতকরা ৯৭ ভাগের ওপর থেকে শুল্কহার প্রত্যাহার করেছে বেইজিং।
তিস্তা নদীর পানিবন্টনের বিষয়টি ভারতের সঙ্গে বছরে পর বছর ঝুঁলে রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতার কারণে এমনটা হচ্ছে। এ অবস্থায় তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনার জন্য চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। ভারত ও চীনের মধ্যে একটি ভারসাম্য অবস্থা বজায় রাখছে বাংলাদেশ। কিন্তু তার মধ্যে ওয়াশিংটন এখন বিশেষভাবে সক্রিয় হয়েছে। নিক্কি এশিয়ান রিভিউয়ে এক ইমেইল বার্তায় প্রফেসর আলী রীয়াজ লিখেছেন, বিরোধপূর্ণ প্রত্যাশার স্থানে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে। যদি জাতীয় স্বার্থ প্রথামিক বিবেচনায় থাকে তাহলে বাংলাদেশ তা করতে পারবে।
বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিকে ওয়াশিংটনের কৌশলের অংশ হলো প্রতিরক্ষা কূটনীতি। কৌশল বা স্ট্রাটেজি নিয়ে ২০১৯ সালে প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের পাশাপাশি একটি ‘উদীয়মান অংশীদার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। লরা স্টোন নিক্কি এশিয়ান রিভিউকে বলেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মুলে রয়েছে একটি সত্য। তা হলো, বাংলাদেশের মতো, যুক্তরাষ্ট্রও ইন্দো-প্যাসিফিকের একটি দেশ। সব দেশের সুবিধার জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্বাধীনতা, উন্মুক্তরণ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার নৌ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই আমরা এমন সব উদ্যোগে জোর দিয়েছি, যা নিরাপত্তাকে সামনে এগিয়ে নেবে।
আলী রীয়াজ বলেন, এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক এজেন্ডা দৃঢ়তার সঙ্গে বাস্তবায়নজরুরি হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। উল্লেখ্য, আলী রীয়াজ একই সঙ্গে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিলের একজন সিনিয়র ফেলো-ও।
২০০৫ সালে পররাষ্ট্র বিষয়ক সামরিক অর্থায়ন স্কিমের অধীনে সন্ত্রাস দমন থেকে শান্তিরক্ষা সহ নিরাপত্তার নানা ক্ষেত্রে এরই মধ্যে সহযোগিতা গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশের নৌ নিরাপত্তা ও গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য ইস্যুতে সহায়তার জন্য বাড়টি ৬ কোটি ডলার দিয়েছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর আমিনা মোহসিনের মতে, চীনের বিআরআই তৎপরতার পাল্টা হিসেবে ‘আগ্রাসীভাবে’ ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু ঠেলে দিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। ২০১৬ সাল থেকে এই বিআরআই-এর অংশীদার বাংলাদেশ। তিনি নিক্কি এশিয়ান রিভিউকে বলেছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং অস্ত্র বিক্রিতে অংশদারিত্ব প্রত্যাশা করে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে কৌশলগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ছিলেন এম. হুমায়ুন কবির। তিনি বর্তমানে ঢাকার থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেছেন, এই অবস্থা বাংলাদেশকে একটি জটিল অবস্থানে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশেরই বন্ধু বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে (এমন আহ্বানে) সাড়া দেয়া হবে জটিল বিষয়।
সরকারি এক ডাটা অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ৭০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি গন্তব্য। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এ দেশটির চীনের সঙ্গে রয়েছে জটিল বাণিজ্যিক ঘাটতি। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১২০০ কোটি ডলার। চীন হলো বাংলাদেশের আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস।
প্রফেসর আলী রীয়াজ পূর্বাভাষ দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতির পরিবর্তন নিয়ে। তিনি মনে করেন নভেম্বরের নির্বাচনে যদি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি সংযুক্ত হবে এ অঞ্চলে। তিনি বিশ্বাস করেন, তা হলেও চীনের যে ক্রমবর্ধমান প্রভাব তার চেয়ে বেশি হবে না যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ।