অ্যাসিড সন্ত্রাস কমেছে নির্মূল হয়নি
বাংলাদেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা বিগত এক দশকের বেশি সময়ে আশাতীতভাবে কমে এলেও ভয়াবহ এই সন্ত্রাস দেশ থেকে একেবারে নির্মূল হয়নি। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এমনটিই জানা গেছে।
বলা হচ্ছে, অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ও শিশুরাই এগিয়ে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পুরুষরাও অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধীদের শাস্তি না হওয়া এবং অ্যাসিডের সহজলভ্যতার কারণে অ্যাসিড সন্ত্রাস এখনো নির্মূল করা যাচ্ছে না। এজন্য ভয়ঙ্কর এই দাহ্য পদার্থটির যাতে অপব্যবহার না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং সতর্কতার সঙ্গে নিরাপদ স্থানে অ্যাসিড সংরক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। এএসএফের তথ্যে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন ১৮ জন। আক্রান্ত হন মোট ২৩ জন। এর মধ্যে তিনজন পুরুষও রয়েছেন। অথচ এক দশক আগেও অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে দেশে ৩ হাজার ৪শ ১২টি অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। সে সময় এই ঘটনায় আহত হন ৩ হাজার ৭৯১ জন। অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন-২০০০ অনুযায়ী, লাইন্সেস ছাড়া অ্যাসিড উৎপাদন, বিক্রি, মজুদ ও ব্যবহার দ-নীয় অপরাধ। কিন্তু অনুমতিপত্র ছাড়াই সারা দেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান অ্যাসিড বিক্রি, উৎপাদন ও মজুদ করছে। জেলায় জেলায় জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল থাকলেও অ্যাসিড বিক্রি ও ব্যবহারের ওপর এর কোনো তদারকি নেই। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, আইনের শিথিলতা কিংবা সাক্ষী না পাওয়ার কারণে অ্যাসিড নিক্ষেপের প্রায় ৭০ শতাংশ ঘটনায় আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার অ্যাসিড নিক্ষেপের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হলেও পুলিশ প্রতিবেদন যথাযথ না হওয়ায় অপরাধীরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে কিংবা তাদের কম সাজা হচ্ছে। এএসএফের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ অ্যাসিড ছুড়ে মারার ঘটনা অনেকাংশে কমে গেছে। অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সফলতা এসেছে। আমরা জনগণকে সচেতন করতে পেরেছি। এসব বিষয়ে আইনি বিষয়গুলোও এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে যে, এই অপরাধের হার কমে গেছে। কিন্তু মহামারীতে কারও ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এ সময় অনেক কিছুতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল ছিল। আর এই সময়টি ব্যবহার করেছে অপরাধীরা। তাই করোনাকালেও কিছু দুর্বৃত্ত অ্যাসিড ছুড়েছে। তারপরও আমি বলব তুলনামূলক অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা অনেক কমেছে। নারীর প্রতি অন্যান্য সহিংসতার তুলনায় অ্যাসিড সহিংসতা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।’বিশেষজ্ঞরা বলেন, অ্যাসিডের সহজলভ্যতা রয়েছে। আবার যারা সার নিয়ে কাজ করেন বা ব্যবসায়ী তাদের কাছেও সহজে দাহ্য এই পদার্থটি পাওয়া যায়। যারা অ্যাসিড নিক্ষেপ করে তাদের কাছে দাহ্য এই রাসায়নিকটি সহজলভ্য। সুতরাং যারাই প্রয়োজনে অ্যাসিড নিয়ে কাজ করেন তাদের একটি বিষয়ে সচেতন হতে হবে, অ্যাসিড যেন চাইলেই অন্য কেউ ব্যবহার করতে না পারে। সতর্কতার সঙ্গে নিরাপদে এই দাহ্য পদার্থটি সংরক্ষণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এর যেন কোনো অপব্যবহার না হয়। তারা আরও বলেন, অ্যাসিড নিক্ষেপকারীদের দ্রুতবিচার আইনে শাস্তি দেওয়া উচিত। যত্রতত্র অ্যাসিড বিক্রি হচ্ছে কি না- তা তদারকির কাজ জাতীয় কাউন্সিলের। কাউন্সিলের সদস্যরা মাঠপর্যায়ে কাজ না করলে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, সাধারণত পুরুষরা অনিয়ন্ত্রিত রাগের বশবর্তী হয়ে প্রায়ই নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করে। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সম্পত্তি বা জমি দখল করার কারণেও দুর্বৃত্তরা অ্যাসিড নিক্ষেপ করে থাকে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে, দেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা অনেকাংশে কমে এসেছে। তবে এটি একেবারে বন্ধ হয়নি। ’৮৬ সালের দিকে মনে আছে তখন মেয়েরা কোনো ছেলের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে তার দিকে অ্যাসিড ছুড়ে মারা হতো। সে সময় এ ধরনের ঘটনাও বেশি ছিল। কিন্তু এখন যে কোনো শত্রুতার কারণে যেমন- রাজনৈতিক, জমি-সংক্রান্ত সমস্যা হলেই অ্যাসিড ছুড়ে মারা হচ্ছে। যে কেউ এখন চাইলেই গ্যারেজে গিয়ে অ্যাসিড কিনে নিয়ে আসতে পারে। আর অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার ব্যক্তিরা মারা না গেলেও তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কারণ ভুক্তভোগীকে দেশে-বিদেশে যতই চিকিৎসা করানো হোক, তার আগের মতো অবস্থায় ফিরে যাওয়া আর সম্ভব হয় না।’