যোগসাজশে ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা-ফেনসিডিল
করোনার নেতিবাচক প্রভাবে সবার নিয়মিত কাজ কম-বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে। তছনছ হয়ে যাওয়া দিনপঞ্জির সময়সূচি রক্ষা করা এখন বেশ জটিল। এর মধ্যে সারা দেশে মাদকদ্রব্য ঢুকে সয়লাব হয়ে পড়েছে।
মাদক ব্যবসায়ী, চোরাচালানকারী চক্র এটিকে মোক্ষম সময় ধরে নিয়ে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। টেকনাফের সাবরাং লাফারঘোনা পয়েন্টে সেদিন ধরা পড়েছে এক লাখ বিশ হাজার পিস ইয়াবা, যার দাম তিন কোটি ষাট লাখ টাকা। এর পরদিন কোস্টগার্ডের কাছে সাবরাং খুরেরঘাট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহীর ব্যাগ থেকে ধরা পড়ল আরও ছাপ্পান্ন হাজার পিস। প্রতিবেশী মিয়ানমার এসব ইয়াবার উৎসস্থল।
নাফ নদীর তীরে তো ইট-কাঠের বেড়া নেই। আছে ‘মানববেড়া’। সীমান্তরক্ষীদের সতর্ক দৃষ্টিতে এবার ইয়াবাভর্তি নৌকা ফেলে লাফারঘোনা পয়েন্টের কেওড়াবনের দিকে লাফিয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেছে চোরাচালানকারী চক্রের সদস্যরা।
উদ্বেগজনক হল, হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে মাদকের চোরাচালান। দেশের ৩২ জেলার ৪২টি সীমান্ত পয়েন্টের ‘ফুটো’ দিয়ে ঢুকছে ফেনসিডিল। টেকনাফের ৩০টি পয়ন্টে দিয়ে আসছে ইয়াবা। এ উপজেলার ২৫ কিলোমিটার সীমান্ত পথ অরক্ষিত।
এ পথে চারটি পয়েন্টে বেশ জমজমাট মাদক ব্যবসা। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় একশ্রেণির নীতিহীন ব্যবসায়ীর যোগসাজশে মাদকদ্রব্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। বস্তুত একশ্রেণির লোভী ব্যবসায়ী স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ঘৃণ্য এ মাদকব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর সংবাদ হল- বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই মাদক পাওয়া যাচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে কি পুরো দেশটাই মাদকের আখড়া হয়ে গেছে? এমনটি ঘটলে এ দেশের ভবিষ্যৎ কী?
সীমান্তে মাদক প্রতিরোধের জন্য নিয়োজিত দায়িত্ব পালনরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত তৎপরতার মধ্যেও দেশের ভেতর ইয়াবা, ফেনসিডিলের প্রবেশ ঘটে কীভাবে, এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাদকের থাবায় ব্যক্তি ও সমাজজীবনে ঘৃণ্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
অবৈধ মাদক ব্যবসা যদি স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ক্রমাগতভাবে চলতেই থাকে, তবে তাদের পেছনে রাষ্ট্রের কাঁড়ি-কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করার আদৌ কি কোনো প্রয়োজন আছে? দেশের প্রতিটি গ্রামে যদি মাদকের প্রাপ্তি ঘটে, সব জায়গায় যদি মাদক ব্যবসায়ী ও এর মদদদাতাদের খোঁজ মিলে, তবে সঙ্গত কারণেই শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই।
করোনাকালীন ঘরে বসে নিত্যপণ্য হাতে পেতে নিরাপদ ই-ব্যবসা চালু হয়েছে। তৈরি খাবার, কাঁচাবাজার, ইলেকট্রনিক্স, ওষুধ, বিলাসদ্রব্য সবকিছু মোড়কে ভরে বাড়ি বাড়ি বিপণন ও সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হওয়ার সুবাদে মাদক ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের মওকা পেয়ে গেছে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রক্রিয়ায় ‘হোম ডেলিভারির’ মাধ্যমে মাদকদ্রব্য ঘরে ঢোকার পথ খুঁজে নিচ্ছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদ ও গ্রামের হাটবাজারে নিত্যপণ্যের মোড়কে মাদক সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে।
মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কেউ ধরা পড়লেই গডফাদারদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। আমাদের দেশে নৈতিক চরিত্রহীন কিছু মানুষের ছত্রছায়ায় ঘুষ ও পেশিশক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত এ ন্যক্কারজনক ব্যবসা চালু রয়েছে, যা সবাই জানে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক চৌকস ও নীতিবান সদস্যের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তদন্ত কাজে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু অনেক সময় ওপর মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপে তারা ভালোভাবে তদন্ত করেও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইনের কঠোরতা কিংবা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন না। এভাবে দিনের পর দিন মাদকের ব্যবসা চলতে পারে না।
আশঙ্কাজনক হল, প্রতিদিন নৌপথে মাদকের যেসব বড় বড় চালান আসছে, তার ২ শতাংশও ধরা পড়ছে না। ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সোর্স আছে, যারা মাদকের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করে থাকেন; কিন্তু সোর্সদের কোনো টাকা দেয়া হয় না।
প্রচলিত আছে, ১ হাজার বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার হলে সোর্সকে দিতে হয় ৩০০ বোতল। পরবর্তী সময়ে সোর্সরা ওইসব মাদক স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন।’ অথচ সোর্সমানি হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, যার কোনো হিসাব দেয়া হয় না।
মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত পদ্ধতি ও কৌশল আধুনিক যুগের সঙ্গে যায় না। চোর প্রতিদিন চুরি করে আর ভাবে- তার কিছুই হবে না! মাদক ব্যবসায়ী ভাবে- তার বড়ভাই আছেন, ধরা পড়লে তিনিই তাকে ছাড়িয়ে আনবেন।
এসব চোর-ডাকাতের শাস্তিদাতাকে তাদের উপরওয়ালারা শাসায় ও বড় অঙ্কের অর্থলোভ দেখিয়ে নিবৃত্ত করে। মূলত এর ফলেই টেকনাফের সাবরাং লাফারঘোনা মেরিনড্রাইভের কাছে কেওড়াবনে লাফিয়ে লাফিয়ে ইয়াবা চোরদের পলায়ন করার মতো পরিস্থিতি দেশের সব সীমান্ত, সব পয়েন্ট, সব বড়মাথা ও কথাওয়ালাদের আশপাশে প্রতিদিন ঘটে। আমরা টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা ও ইন্টারনেটে এসব সংবাদ ও ফিচার পড়ি আর হা-হুতাশ করে দিন কাটাই।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান