শিল্পী সংকটে ঢাকাই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ
ঢাকাই চলচ্চিত্রে দীর্ঘদিন ধরে নায়ক-নায়িকা হিসেবে অনেকেরই আসা-যাওয়া চলছে। তাদের মধ্যে কেউ নিজ মেধা গুণে টিকে গেছেন কেউবা আবার ক্যারিশমা দেখাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে। অনেকে আবার ঢিমেতালে এগিয়ে যাচ্ছেন।
নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে শিল্পী সংকটে পড়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্র। অভিনেতার ক্ষেত্রে শাকিব খান ছাড়া মুনাফা বা পুঁজি ফেরত আনার মতো আর কোনো শিল্পী নেই বলে জানান নির্মাতারা। আর অভিনেত্রীর ক্ষেত্রে দুই বাংলায় সাড়া জাগিয়েছেন জয়া আহসান ও মাহিয়া মাহী। হাতেগোনা এ কজন শিল্পী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নির্মাতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। ঢাকাই ছবির বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা হার্টবিট প্রোডাকশন হাউসের কর্ণধার তাপসী ফারুক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দর্শকগ্রহণযোগ্য নায়ক-নায়িকার অভাবে ছবি এখন আর ব্যবসাসফল হয় না। একমাত্র শাকিব খানকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করলে সেই ছবি ব্যবসার মুখ দেখে। কিন্তু এই শীর্ষনায়ককে নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলে একদিকে সিডিউল জ্যাম অন্যদিকে বাজেটও বেশি রাখতে হয়। বেশি বাজেটের সিনেমা নির্মাণ সমস্যা নয়, সমস্যা হলো সিনেমা হলের সংখ্যা এখন একশরও নিচে নেমে আসায় মুনাফা দূরে থাক পুঁজিই ফেরত আনা সম্ভব হয় না। বেশ কজন নির্মাতা বলেন, নামি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া ২০১২ সাল থেকে প্রচুর নতুন মুখ উপহার দিলেও মাহিয়া মাহী ছাড়া আর তেমন কেউ এই অঙ্গনে বড় মাপের প্রতিষ্ঠা পায়নি। বর্তমানে জাজ মাল্টিমিডিয়া নির্মাণে সক্রিয় নেই বলে দেশীয় চলচ্চিত্র নতুন মুখ উপহার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ অন্য প্রযোজনা সংস্থাগুলো নতুন মুখ নিয়ে ছবি নির্মাণে সাহসী হয় না। জাজ মাল্টিমিডিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একদিকে শিল্পী, অন্যদিকে ছবি সংকটে পড়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্র। কারণ জাজ যৌথ এবং স্থানীয় মিলিয়ে বছরে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি উপহার দিয়ে আসছিল। এতে নির্মাতা-শিল্পী-কলাকুশলী ও সিনেমা হলের মালিক- কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেশীয় চলচ্চিত্রের খরার মধ্যেও স্বস্তি ফিরে পেয়েছিলেন। বর্তমানে দর্শকগ্রহণযোগ্য শিল্পী সংকটে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে নির্মাতাদের কপালে।
শাকিব খানই ভরসা
চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থাগুলোর মতে, প্রায় দুই দশক ধরে শাকিব খানই দর্শক-নির্মাতাদের ভরসার পাত্র হয়ে আছেন। শাকিব খান মানেই রেন্টাল আর টেবিল কালেকশনের পাহাড়। নিশ্চিতভাবে পুঁজি আর মুনাফার মুখ দেখা। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে দুই দশকে তার ধারেকাছে কেউ ঘেঁষতে পারেনি। এর সাম্প্রতিক প্রমাণ করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘ ছয় মাস পর গত ১০ সেপ্টেম্বর ‘নবাব এলএলবি’ ছবির কাজে শাকিব খান ফিরলে চলচ্চিত্র জগৎসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দেয়। পত্র-পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল, সামাজিক, যোগাযোগমাধ্যমগুলো শাকিবের প্রত্যাবর্তনের সংবাদ ফলাও করে প্রচার করে। চলচ্চিত্র গবেষক, শিক্ষক ও নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, শাকিব খান আসলেই একজন জাত অভিনেতা। কিন্তু আমরা তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছি না, সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। এর চেয়েও বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো শাকিব খান যখন চলচ্চিত্রে আসেন তখন ছিল চলচ্চিত্রের কঠিন মন্দ সময়। অশ্লীলতার আগ্রাসনে অস্থির চলচ্চিত্র অঙ্গন। সে সময় কাজী জহির, ইবনে মিজান, খান আতা, কামাল আহমেদ, সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেন প্রমুখের মতো প্রখ্যাত নির্মাতারা নির্মাণে ছিলেন না। তাই তাকে সিংহভাগ আনকোরা নির্মাতার নির্দেশনায় কাজ করতে হয়েছে। এতে শাকিব তার মেধা আর মনন দিয়েই যতদূর সম্ভব নিজে এগিয়েছেন এবং দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখনো অভিনেতাদের মধ্যে ঢাকাই চলচ্চিত্রে একমাত্র শাকিব খানই ভরসা হয়ে আছেন। তার কোনো বিকল্প নেই। শুধু দেশ নয়, বিদেশের মাটিতেও শাকিব তার কাজের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। একাধিকবার অর্জন করেছেন দেশে জাতীয়সহ দুই বাংলায় নানা সম্মাননা।
দুই বাংলায় দর্শকপ্রিয় জয়া
জয়া আহসান শুধু দেশে নয়, ওপার বাংলায়ও মেধাবী কাজ দিয়ে অতি সহজে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ২০০৪ সালে ‘ব্যাচেলর’ ছবির মধ্য দিয়ে বড় পর্দায় তার অভিষেক। প্রথম ছবিতেই দর্শকপ্রশংসা কুড়ান তিনি। ২০১০ সালে অভিনয় করেন বিকল্প ধারার ছবি ‘ডুবসাঁতার’-এ। ২০১১ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘গেরিলা’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ে দর্শক ও চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জয় করে নেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর সম্মাননা। জয়া শুধু বিকল্পধারা কিংবা বিষয়ভিত্তিক ছবিতে মানসম্মত কাজ দেখাননি, বাণিজ্যিক ছবি পূর্ণদৈর্ঘ্য ‘প্রেমকাহিনী’তে শীর্ষ অভিনেতা শাকিবের সঙ্গে সমানতালে অভিনয় করে নিজের অভিনয় জাত চিনিয়েছেন। এ পর্যন্ত চারবার জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জয়া শুধু নিজ দেশে তার প্রতিভাকে সীমিত রাখেননি, ওপার বাংলায়ও আপন মেধার স্বাক্ষর রেখে জয় করে নিয়েছেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসহ নানা সম্মান। ওপারের ‘রাজকাহিনী’ কিংবা ‘বিসর্জন’ ছবিতে তার অভিনয় মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেছেন দর্শক। দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয়তায় এখনো কাজ করে যাচ্ছেন জয়া আহসান।
পছন্দের তালিকায় মাহী
২০১৩ সালে নামি প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে ‘ভালোবাসার রঙ’ ছবির মাধ্যমে চিত্রজগতে অভিষেক মাহিয়া মাহীর। প্রথম ছবিতেই দক্ষ অভিনয় দিয়ে বাজিমাত। তারপর শুধুই সফলতার পথ ধরে তার এগিয়ে যাওয়া। অভিনয়ের সূচনাতেই মন জয় করে নেন দর্শক-নির্মাতাদের। বর্তমানে কোনো নির্মাতা ছবি নির্মাণ করতে গেলে নায়িকা হিসেবে পছন্দের তালিকায় প্রথমেই চলে আসে মাহীর নাম।
আশাজাগানিয়া পরীমণি
২০১৫ সালে ‘ভালোবাসা সীমাহীন’ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে আসেন বিউটি কুইনখ্যাত পরীমণি। এরপর একাধারে আশাজাগানিয়া নায়িকা হয়ে প্রচুর ছবিতে কাজ করে চলেছেন পরী। তার ফিল্মি ক্যারিয়ারে যোগ হয়েছে জাজ মাল্টিমিডিয়ার ‘রক্ত’, গিয়াসউদ্দীন সেলিমের ‘স্বপ্নজাল’, চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্বসুন্দরী’র মতো আলোচিত ছবি। ‘আমার প্রেম আমার প্রিয়া’ ছবিতে মনকাড়া অভিনয় করে জিতে নিয়েছেন সেরা অভিনেত্রী হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড। পরী এখনো দর্শক-নির্মাতাদের হৃদয়ে আশা জাগিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
আলোচনায় শুভ-সিয়াম
আরিফিন শুভ ২০০০ সালের প্রথমদিকে ‘জাগো’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। প্রথম ছবিতেই ছোট্ট একটি চরিত্রে দক্ষ অভিনয় দিয়ে দর্শক-নির্মাতার মন কাড়েন। এরপর বেছে বুঝে ছবিতে অভিনয় করেন এবং সুঅভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবিতে অভিনয় করে জিতে নেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অন্যদিকে সিয়ামের অভিষেক ঘটে জাজ মাল্টিমিডিয়ার
‘পোড়ামন টু’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। প্রথম ছবিতেই দক্ষ অভিনয় দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর ‘দহন’, ‘বিশ্বসুন্দরী’সহ অনেক আলোচিত ছবিতে অভিনয় করে নিজেকে আলোচনায় রাখেন সিয়াম।
বুবলী উধাও
শবনম বুবলী ২০১৬ সালে ‘বসগিরি’ ছবির মাধ্যমে শাকিব খানের বিপরীতে পর্দায় আসেন। প্রথম ছবিতেও ইনোসেন্ট লুক দিয়ে দর্শক-নির্মাতার মন কাড়েন। এরপর ১০টি ছবি মুক্তি পায় তার। সবকটিই ব্যাপক আলোচনায় আসে। সর্বশেষ ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ক্যাসিনো’ ছবি দুটিতে অভিনয় করার পর ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। তার এই অন্তর্ধান নিয়ে নানা কল্পকাহিনি চাউর হলেও আগামীই বলে দেবে তার আত্মগোপনের রহস্য।
চমক দেওয়া পূজা চেরী
জাজ মাল্টিমিডিয়ার ‘অগ্নি’ ছবির মাধ্যমে শিশুশিল্পী হিসেবে বড় পর্দায় আসা পূজা চেরী অল্প সময়ের মধ্যেই এই প্রযোজনা সংস্থার ‘নূরজাহান’ ছবির মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর ‘পোড়ামন টু’ ছবিতে সুঅভিনয় দিয়ে দর্শক-নির্মাতার মন পুড়িয়ে ছাড়েন সুনয়না পূজা।
এভারেজে সায়মন-বাপ্পী
২০১০ সালে ‘জ্বী হুজুর’ ছবি দিয়ে সায়মন ও ২০১৩ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ নিয়ে বড় পর্দায় আসেন বাপ্পী। শুরুতেই দর্শক-নির্মাতার মনে আশা সঞ্চার করলেও এভারেজে এগিয়ে যাচ্ছেন এই দুই অভিনেতা। তবে ‘জান্নাত’ ছবিতে অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেতার সম্মান জিতে নিয়েছেন সায়মন।