তারা ছিলেন অভিমানী
‘আত্মহত্যা’- পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত একটি শব্দ ও কাজ। লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজের জীবন নিজেই কেড়ে নেয়া! এর চেয়ে ভয়ঙ্কর, বিব্রতকর ও কষ্টকর আর কোনো কিছুই হয়তো নেই।
তবুও আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে আমাদের সমাজে, দেশে ও পুরো বিশ্বে। সাধারণ মানুষদের পাশাপাশি মিডিয়ার তারকাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
বিশ্বে তো বটেই, দেশেও বিভিন্ন অঙ্গনের অনেক শিল্পী আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর অজানা। মৃত্যুর পর হয়তো আমরা কিছু কিছু ঘটনা জানতে পারি বা সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ করতে পারি কিন্তু চলে যাওয়া ব্যক্তির বিষাদময়তা উপলব্ধি করতে পারি না। ঢাকাই মিডিয়ায় আত্মহত্যা করা শিল্পীদের নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদন।
একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু সব কিছুর পেছনে যে জীবনের প্রতি অভিমান- এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কী বা কোন কারণে এ অভিমান মনের মাঝে তৈরি হয়- সেটি একমাত্র চলে যাওয়া ব্যক্তিই বলতে পারেন, জীবিতরা নয়।
হয়তো নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা তৈরি করে নেয়া যেতে পারে কিন্তু অভিমানের ঝাঁপি খুলে দিয়ে যে চলে যায় সেটির কারণ সত্যিই অজানাই থাকে। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে হয়তো মানসিক রোগ বা সেটির ক্ষণিকের উপস্থিতিটিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আদৌ কি তা সত্যি?
১৯৯১ সালের ৩ জুলাই হঠাৎ করেই জানা গেল, অভিনেত্রী ডলি আনোয়ার আর নেই। খবর রটল তিনি আত্মহত্যা করেছেন। স্বামীর পরকীয়া ও সেটি নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া- এটিই পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যার কারণ বলে জানা গেছে। কে এ ডলি আনোয়ার- সেটি একটু জেনে নেয়া যাক। তিনি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষানুরাগী ও সাহিত্যিক ড. নীলিমা ইব্রাহিমের মেয়ে। পিতা চিকিৎসক। আন্তর্জাতিক চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী।
বিখ্যাত ছবি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’তে জয়গুন চরিত্রে অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান। স্বামী কর্তৃক তালাক ও মায়ের অবহেলাই নাকি এরকম উচ্চশিক্ষিত একটি মেয়েকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে তার মৃত্য নিয়ে রয়েছে বেশ রহস্য।
ঢাকাই মিডিয়ায় এ ডলিকে দিয়ে আত্মহত্যার ইতিহাস রচনা শুরু। এরপর ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ছিল আরও একটি বিষাদের দিন। এদিনে দেশের বেশিরভাগ তরুণের হার্টথ্রব নায়ক সালমান শাহ স্বেচ্ছায় ফাঁসির দড়ি গলায় জড়িয়ে নেন। এখানেও পারিবারিক অশান্তির গল্প উপস্থিত।
ক্যারিয়ারে সফলতার শীর্ষে থাকা একজন অভিনেতা কোন অভিমানে নিজের জীবন একেবারে তুচ্ছভাবে বিসর্জন দিয়ে দেয়- সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু এ মৃত্যু ইন্ডাস্ট্রির জন্য শোকের, আক্ষেপের ও যাতনার। যদিও সালমানের মৃত্যু নিয়ে এখনও তার মা ও স্ত্রীর মধ্যে আইনি লড়াই চলছে।
এরপর ঢাকাই মিডিয়ায় আত্মহত্যার তালিকা শুধুই বেড়েছে। অভিমানে চলে গেছেন অনেকে। তার মধ্যে অন্যতম অভিনেত্রী মিতা নূর। নব্বই দশকের দারুণ জনপ্রিয় এক অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসার ড্রয়িংরুম থেকে অভিনেত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ মৃত্যুর রহস্য আজও জানা যায়নি। যদিও তার বাবা এটিকে স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক অশান্তি বলেই দাবি করেছেন। মিতা নূরের ঠিক আগের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের ২৭ মার্চ আত্মহত্যা করেন মডেল অভিনেতা মঈনুল হক অলি। তার মৃত্যুর পেছনেও দাম্পত্য কলহ ও বনিবনার অভাবকেই দায়ী করা হয়। পাশাপাশি নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও হতাশায় ছিলেন এ অভিনেতা।
২০১৩ সালের ২৪ মার্চ নিজ ফ্ল্যাটে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন লাক্স তারকা সুমাইয়া আসগর রাহা। এখনও এ আত্মহত্যার কোনো কারণ জানতে পারেননি কেউ। তবে তার বাবা মেয়ের মৃত্যু নিয়ে একেকবার একেক রকম তথ্য দিয়েছেন। ২০১৪ সালের রোজার ঈদের দিন ফ্যানের সঙ্গে প্রেমিকার ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন ২১ বছর বয়সী সঙ্গীতশিল্পী পিয়াস রেজা।
এ মৃত্যুটি যে প্রেমঘটিত ছিল- সেটি আত্মহত্যার ধরন থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। ২০১৪ সালে আত্মহত্যা করেন হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিন রাত্রি’ ধারাবাহিক নাটকের টুনি চরিত্র রূপদানকারী অভিনেত্রী লোপা নায়ার। তার মৃত্যুর পেছনেও পারিবারিক অশান্তির কারণটিই সামনে উঠে এসেছে। ২০১৫ সালের ২০ মার্চ রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে তরুণ অভিনেত্রী নায়লার সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ মৃত্যুটিও নাকি ছিল পরিবার ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা।
২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে চট্টগ্রামের নিজ গ্রামের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন অভিনেত্রী জ্যাকুলিন মিথিলা। তিনি মূলধারায় খুব বেশি কাজ না করলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ পরিচিত ছিলেন। কিছুটা বিতর্কিতও ছিলেন। সেই বছর ২২ জুলাই আত্মহত্যা করেন দেশের অন্যতম সঙ্গীত পরিচালক, মাইলস ব্যান্ডের কিবোর্ডিস্ট মানাম আহমেদের ছোট ছেলে এ প্রজন্মের অন্যতম ব্যান্ড ম্যাকানিক্সের গিটারিস্ট জাহিন আহমেদ। তার মৃত্যুর কারণ পরিবার এখনও জানায়নি।
একই বছরের ৩১ জুলাই আত্মহত্যা করেন র্যাম্প মডেল ও অভিনেত্রী মডেল রিসিলা বিনতে ওয়াজের। এ মৃত্যুর পেছনেও দাম্পত্য কলহের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এ র্যাম্প মডেল।
২০১৮ সালের ৯ মে রাজধানীর মিরপুরে চিত্রপরিচালক শামীম আহমেদ রনির সাবেক স্ত্রী ও অভিনেত্রী তমা খান গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ মৃত্যুটিকেও স্বামীর পরকীয়ার বলি হিসেবে অনেকে মনে করেন।
সর্বশেষ চলতি বছর ৩০ আগস্ট রাজধানীর বারিধারায় নিজের বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন এ প্রজন্মের তরুণ মডেল ও অভিনেত্রী লরেন মেন্ডেস। মৃত্যুর মাত্র দু’দিন আগেও নাটকের শুটিং করেছেন এ অভিনেত্রী। এ মৃত্যুটিও পারিবারিক কলহ ও প্রেমঘটিত কারণে হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
এক গবেষণায় দেখা গেছে- বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করেন, যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। এদের মধ্যে আবার তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এর চেয়ে আরও ১০ গুণ বেশি মানুষ। শহরের চেয়ে গ্রামে আত্মহত্যার হার ১৭ গুণ বেশি।
গ্রামে যারা আত্মহত্যা করেন, তাদের বড় অংশ অশিক্ষিত এবং দরিদ্র। এ অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র মানুষগুলো হয়তো জীবন সম্পর্কে ধারণা না পেয়ে বা জীবনযুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর পথ বেছে নেয়। কিন্তু মিডিয়ার আলোঝলমলে জীবনে যাদের পা পড়েছে; যারা অনেকের অনুকরণীয় বা অনুসরণীয়; তাদের স্বেচ্ছামৃত্যু সমাজে খুব বড় প্রভাব ফেলে। এটি নিশ্চয়ই জীবদ্দশায় সবারই বোঝা উচিত।