বাসে নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই, মন্ত্রী বললেন সন্তোষজনক
গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে গণপরিবহন স্বাভাবিক চলাচলের শুরু থেকেই মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। যত সিট তত যাত্রী এই নিয়মে গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনা থাকলেও মানা হচ্ছেনা। যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন চালক ও কর্মীদের নেই ভালো ব্যবহার, ভাড়া দাবি করা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। সে যেন সেই পরিচিত শহরের বাদুড় ঝোলা বাসের প্রতিচ্ছবি। তবুও পরিস্থিতি সন্তোষজনক দেখছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
প্রথম আলোর সাক্ষাৎকারে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সারা দেশে খোঁজ নিয়ে তিনি যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে পরিস্থিতি সন্তোষজনক। সরকার কঠোর নজরদারি করছে। স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, মানুষের নিজের স্বার্থেই স্বাস্থ্যবিধি মানা উচিত। সরকার সারা দেশেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সব আসন পূর্ণ করে চলছে গণপরিবহন। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি। কিছু যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। অধিকাংশ গণপরিবহনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নেই। শুধু রাজধানী নয় দেশের বিভিন্ন স্থানেও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, অফিসগামী মানুষের প্রচন্ড ভিড়। বাসের সংখ্যাও বেশি। কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে খুব একটা মানুষকে বাসে উঠছেনা। তারা বলছেন, প্রতি আসনে যাত্রী পরিবহন করলে সামাজিক দূরত্বও নিশ্চিত হয় না। কোথাও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার বা স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। তাছাড়া প্রতিটি সিটে যাত্রী তোলা হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে করোনাকালে গণপরিবহন তাদের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে পারেনি বাস মালিকরা।
দেখা গেছে প্রতি আসনে যাত্রী তোলার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত সরকার দিয়েছিল, তা অনেকাংশে পালিত হয়নি। দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। ১ জুন থেকে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার শর্তে বাস চলাচলের সুযোগ দেয় সরকার। বাস মালিকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভাড়া বাড়ানো হয় ৬০ শতাংশ। ফলে যাত্রীর ওপর চাপ পড়ে। এখন ভাড়া আগের জায়গায় গেল। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধির বালাই না থাকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ল।
ওদিকে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা খুব কমে গেছে, তা নয়। গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৯৫০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৩৫ জন।
এরই মধ্যে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তাই এই নিরাপত্তাহীনতার দায় সরকারের কাঁধে দিতে দিধা নেই তাদের। তারা বলছেন, মানুষের প্রয়োজনের গণপরিবহণ যেমন প্রয়োজন তার থেকে মানুষের নিরাপত্তা প্রয়োজন। বাস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরকার কঠর হলে বাস মালিকরা এসব সুযোগ পায়না।
একদিকে মাস্কে হাঁসফাঁস জীবন। অন্যদিকে বাস মালিকদের খামখেয়ালিপনা। কেমন নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটছে সাধারণ মানুষের। তারা বলছেন, বাসের প্রতি মানুষে আস্থা নেই। করোনাকালে যেসব নিয়ম মানার কথা ছিল, তার ধারে কাছেও তারা নেই।
যাত্রাবাড়ি মোড়ে দেখা গেছে, অফিসগামী মানুষের প্রচন্ড ভিড়। বাসের সংখ্যাও বেশি। কিন্তু খুব একটা মানুষকে বাসে উঠতে দেখা যায়নি। তারা বলছেন, করোনাকালে গণপরিবহন তাদের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে পারেনি। কোথাও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার বা স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। তাছাড়া প্রতি আসনে যাত্রী পরিবহন করলে সামাজিক দূরত্বও নিশ্চিত হয় না। ভাড়া নিয়েও প্রতিসময় হেল্পারদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা করতে হয়। জানতে চাইলে তারা জানান, যাত্রী তোলা হয়েছে প্রতিটি সিটে। অথচ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা খলিলুর রহমান বলেন, বাধ্য হয়েই বাসে যাতায়াত করতে হয়। অথচ ভাড়া বেশি নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। তুহিন নামের এক বৃদ্ধ বলেন, যেভাবে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে, তা আমি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করি। তাই রিকশা বা সিএনজি করেই যাতায়াত করছি।
বাংলামোটর এলাকায় দেখা গেছে, রিকশা, সিএনজি ও মোটরসাইকেলের সংখ্যাই বেশি। সড়কে চলাচলরত অধিকাংশ বাসের আসন ফাঁকা। কথা হয় মিরপুর থেকে শিকড় পরিবহনে করে আসা যাত্রী মো. মামুনের সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করেন, পরিবহন কর্মীদের ব্যবহার ভালো না। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে এখানে আসতে ভাড়া নিয়ে অন্তত ১৫ জন যাত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করেছে কন্ডাক্টর।
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আসাদ গেট, শ্যামলী, কলেজ গেট, কল্যাণপুর, গাবতলী, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকায় গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, বাসগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের ভাড়াই নেওয়া হচ্ছে। বিকেলে অফিস ছুটি হওয়ার পর দু-একটি বাসে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে। এর একটি গুলিস্তান-ধামরাই পথের ডি-লিংক পরিবহন। বিকেল চারটার দিকে কল্যাণপুর এলাকায় দেখা যায়, এই কোম্পানির একটি বাসে তিনজন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। বাসের শ্রমিক মিনার হোসেন দাবি করেন, বাসের কয়েকটি আসনে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এ জন্যই তিনজন দাঁড়িয়ে।
রাজধানীর উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, যাত্রাবাড়ী, সদরঘাটসহ বেশ কিছু পথের বাসের শেষ গন্তব্য গাবতলী টার্মিনাল। যাত্রী নামিয়ে ফিরতি যাত্রা শুরুর আগে বাস-মিনিবাস জীবাণুমুক্ত করার কথা। কিন্তু যাত্রাবাড়ী-গাবতলী পথের তিনটি বাস জীবাণুনাশক না ছিটিয়েই যাত্রী নিয়ে ফিরতি যাত্রা শুরু করে। একই চিত্র দেখা গেছে প্রজাপতি, বসুমতী, রব রব ও জাবালে নূর পরিবহনেও। বাসের ভেতর জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকার কথা। কিন্তু কোনো বাসেই এ ধরনের কিছু পাওয়া যায়নি। তবে কোনো কোনো বাসের দরজার সামনে ব্লিচিং পাউডারমিশ্রিত ভেজা চট বিছিয়ে রাখতে দেখা গেছে।
বিকেলে খামারবাড়ি মোড়ে স্বাধীন পরিবহনের একটি বাসের যাত্রী আবুল খায়ের বলেন, মাস্ক মুখে দিলে হাঁসফাঁস লাগে। এ জন্য পকেটে রেখে দিয়েছেন। একই বাসের চালকের সহকারী আতাউর রহমানের মুখেও মাস্ক ছিল না। তাঁর অজুহাত, যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, হাঁকডাক দেওয়া লাগে। তাই মাস্ক পরে থাকা সম্ভব নয়। বললেন, ‘ঝুঁকি বুঝি। কিন্তু কী করব?’
পরিবহনমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, তাঁদের চালক-সহকারী সবাইকে মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে। যাত্রীদের তো শ্রমিকেরা বাধ্য করতে পারবেন না। তিনি দাবি করেন, জীবাণুমুক্ত করার বিষয়েও কড়া নির্দেশনা দেওয়া আছে।
ঢাকার বাইরে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহরের বাসগুলোয় ভাড়া ঠিক থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। এর মধ্যে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর উল্লেখযোগ্য। প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানান, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় যাত্রী অনেক কম ছিল। চালক-সহকারী ও পরিবহনশ্রমিকদের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। যাত্রীদেরও অনেকে মাস্ক ছাড়া যাতায়াত করছেন। ভাড়া নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত।