ভারতের গোয়েন্দা ব্যর্থতার সুযোগ নিচ্ছে চীন ও পাকিস্তান

0

নয়া দিল্লি ও বেইজিং এখন উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুই পক্ষ এখন পর্যন্ত তাদের অভিন্ন সীমান্তজুড়ে স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও এক সমালোচক প্রশ্ন করেছেন: ভারতের নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্টকে কেন চীন ধোঁকা দিতে পারল? লাদাখের স্থানীয় কর্মকর্তারা কয়েক বছর ধরেই ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনা অনুপ্রবেশের বিপৎসঙ্কেত দিলেও নয়া দিল্লির গোয়েন্দাব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল, তারা ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে পারেনি।

এমনটা এই প্রথম ঘটেছে, এমন নয়। ভারত অতীতের নিরাপত্তা ব্যর্থতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করেনি বলেই মনে হচ্ছে।

১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে ভারতীয় ও চীনা বাহিনী ছোটখাট সঙ্ঘাতে নিয়োজিত হতো, চীন বিরোধপূর্ণ সীমান্তজুড়ে বড় ভূখণ্ডের ওপর তাদের দাবি জানাত। এর জবাবে নয়া দিল্লি তথাকথিত ফরোয়ার্ড পলিসি গ্রহণ করে, বিরোধপূর্ণ এলাকার ওপর ভারতের দাবি ঘোষণার জন্য হালকাভাবে সজ্জিত সৈন্যদের ছোট ছোট দলকে পাঠাত। কিন্তু পর্যাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্র বা লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় ওই নীতি বিপর্যয় ডেকে আনে। ওই কৌশল ১৯৬২ সালের অক্টোবরে অপ্রয়োজনীয় উস্কানি বলে প্রমাণিত হয়, যুদ্ধ-প্রশিক্ষিত পিপলস লিবারেশন আর্মি পূর্ণ শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে। ভারতীয় সামরিক বাহিনী বেশ সাহসিকতা প্রদর্শন করলেও আক্রমণের মুখে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয়ে যায়। আগুয়ান বাহিনীর হামলার মুখে চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকের তেজপুর শহর খালি করতে হয়েছিল।

ভারতীয় অবস্থানকে চীনারা সহজেই জয় করে ফেলেছিল। লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা দখলের সময়ও একই স্টাইল অনুসরণ করতে দেখা গেছে। প্রয়োজন পড়লে ভারতীয় বাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে পারে, এমন সক্ষমতা প্রদর্শন করে চীন পরের মাসেই একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং গালওয়ান ভ্যালির বেশির ভাগ এলাকা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। তবে আকসাই চীন মালভূমির বেশির ভাগ এলাকা নিজেদের দখলে রেখে দেয়। এই ভূমির পরিমাণ সুইজারল্যান্ডের আকারের প্রায় সমান।

ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা এ ধরনের ভয়াবহ ভুল কিভাবে করতে পারলেন? ব্যর্থতার উৎস ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাঠামোগত সমস্যার মধ্যে নিহিত রয়েছে। ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টিলিজেন্স ব্যুরোর দায়িত্ব হলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, পরিপূরক তথ্য সংগ্রহ করা, ও মূল্যায়ন করা। এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা। কারণ এই সংস্থার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ভুল শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। আরো খারাপ ব্যাপার হলো, বিষয়টি তদারকি করার জন্য পার্লামেন্টারি কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ অনেক দেশে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো আবার সম্পদের অভাবে ভুগছে এবং ভারতের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় একেবারে কোণঠাসা থাকে। আর ব্যুরো যেহেতু প্রতিরক্ষা ব্যয় সীমিত করার নীতিকে সমর্থন করতে আগ্রহী থাকে, কাজেই তারা নীতিনির্ধারকদের সামনে চীনা আগ্রাসনের আসন্ন বিপদকে খাটো করে দেখে, প্রবল চীনা হুমকি খারিজ করে দেয়। ফলে চীনা আক্রমণের মুখে ভারতের নিজেকে অপ্রস্তুত দেখার বিষয় অপ্রত্যাশিত নয়।

১৯৬২ সালের সামরিক বিপর্যয় ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে। ভারত তাদের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করার জন্য বড় ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সম্প্রসারণ করার অংশ হিসেবে ১০টি নতুন পার্বত্য বাহিনী ডিভিশন গঠন করা হয়। গোয়েন্দাব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো হয়। এর ফলে নতুন হুমকি মোকাবেলায় ভারত নিজেকে অনেক বেশি প্রস্তুত দেখতে পায়। এর ফলে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান যখন যুদ্ধে নামে, তখন সে ভারতকে প্রস্তুত অবস্থায় দেখতে পায়।

তবে ভারতীয় সামরিক বাহিনী অগ্রগতির এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারেনি। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান বাহিনী যখন নিয়ন্ত্রণ রেখায় হামলা চালায়, তখন ভারতীয় বাহিনী দিবানিদ্রায় ছিল বলেই মনে হয়। এমনকি এক রাখাল সীমান্ত অনুপ্রবেশের খবর জানালেও ভারতীয় বাহিনী তা অগ্রাহ্য করে। ফলে ইসলামাবাদ তাদের অবস্থান সুসংহত করতে সক্ষম হয়।

পাকিস্তানের অগ্রযাত্রায় সামিল ছিল প্রায় দুই হাজার সৈন্য। তারা ৬২ মাইল বিস্তৃত প্রায় ছয় মাইল এলাকা দখল করে ফেলে। এই হামলা এতই প্রবল ছিল যে তাদের সরিয়ে দিতে বিমান সহায়তার দরকার পড়েছিল ভারতীয় বাহিনীর। কিন্তু বিমান সহায়তা আসতেও দেরি হয়েছিল।

ওই সঙ্ঘাতের পর যুদ্ধের কারণ ও ভারতের প্রতিক্রিয়া অনুসন্ধানের জন্য কার্গিল রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়। এতে অনেক সুপারিশের একটি ছিল এই যে গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সমন্বিত কোনো ব্যবস্থা নেই। এর জের ধরে ডিফেন্স ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি ও ন্যাশনাল টেকনিক্যাল রিসার্চ অর্গ্যানাইজেশন নামে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও সেগুলো দ্রুততার সাথে কাজে লাগানোর একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশও ছিল তাতে। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর ফলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে।

ভারতের চোখে ধুলা দেয়ার জন্য সীমান্ত এলাকায় চীনের কাছে একটি পথই ছিল। তা হলো ধোকা দেয়া। ভারত সীমান্তের কাছে চীন জানুয়ারি থেকে বড় ধরনের একটি সামরিক মহড়া শুরু করে। পরে এই বাহিনীকেই আক্রমণকারী বাহিনীতে রূপান্তিত করে ফেলে চীন। চীনারা তাদের দুর্দান্ত গোয়েন্দা তথ্যকে এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগিয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হলো, চলতি বছরের ব্যর্থতার বিষয়টি কি নয়া দিল্লি স্বীকার করেছে? বিশেষ করে যখন নরেন্দ্র মোদির সরকার নিজেকে শক্তিশালী হিসেবে উপস্থাপন করতে আগ্রহী, তখন এ ধরনের ব্যর্থতা কি গ্রহণযোগ্য?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দুর্বলতা এড়ানোর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ইচ্ছা শক্তির। তবে মনে রাখতে হবে, চীনা অনুপ্রবেশের কথা ভারত প্রথমে অস্বীকার করেছিল। তারপর এখন করোনাভাইরাসে জর্জরিত হয়ে পড়েছে ভারত।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com