‘নতুন করে নিবন্ধনের নির্দেশ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের নীলনকশা’
জাতীয় সম্প্রচার কমিশন এবং অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তার আগেই দেশের সমস্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল, জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশনের অনলাইন সংস্করণসমূহ পৃথকভাবে নিবন্ধন করতে নির্দেশ দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এ নির্দেশ সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করবে। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, এই নির্দেশ মূলত: গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিনের অপচেষ্টা বাস্তবায়নের পথে আরো এক আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, দেশের সমস্ত অনলাইন সংবাদ মাধ্যম- এমনকি দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন পোর্টালকে নতুন করে নিবন্ধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে, এই নির্দেশ নিবন্ধিত সংবাদমাধ্যমগুলোকে সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা এবং অপসাংবাদিকতা রোধের কৌশল বলা হলেও মূলতঃ এটি দেশের গণমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ নিশ্চিত করবে। দেশে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা বিদ্যমান থাকার পরও পৃথক নিবন্ধনের এই নির্দেশ সাংবাদিকতার স্বার্থে নাকি গণমাধ্যমকে চাপে রেখে সরকার ও স্বার্থান্বেষী মহলকে সমালোচনা ও জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা- এ প্রশ্ন আসাটা অবান্তর নয়। সংবিধান স্বীকৃত অবাধ তথ্য প্রবাহ ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিতে যেখানে গণমাধ্যমগুলোকে আরো শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করাটাই প্রত্যাশিত, সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার অবাধ তথ্য প্রবাহের সাংবিধানিক অধিকার হরণকে আইনি কাঠামোর অধীনে নিয়ে আসার একের পর এক উদ্যোগ নিচ্ছে। এটা কোনভাবেই আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
তিনি বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যেখানে স্বচ্ছতা- জবাবদিহিতা নিশ্চিতের অঙ্গীকার করা হচ্ছে, সেখানে একইসঙ্গে কিভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সাহসী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার মতো উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে!
করোনা অতিমারির সংকটকালে যখন গণমাধ্যমগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে, তখন খসড়া অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা চূড়ান্ত না করেই তাড়াহুড়ো করে নিবন্ধনের এই নির্দেশ রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রচেষ্টার নিদর্শন- এমন মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, প্রচলিত নিবন্ধনের আওতায় দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনগুলোর অনলাইন পোর্টাল চালু থাকা উচিত ও যুগোপযোগী- গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের এমন মতের তোয়াক্কাই করা হলো না।
বিশেষ করে অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা অনুযায়ী নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ বা কমিশন গঠন চূড়ান্ত না করেই নতুন নিবন্ধনের এই নির্দেশ মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য কার্যকর হুমকি হয়ে উঠার আশঙ্কা অমূলক নয়। আবার নীতিমালায় কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও সেই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কোন ক্ষমতা না থাকায় কার্যত কমিশনও সরকার- বিশেষ করে তথ্য মন্ত্রণালয়ের আজ্ঞাবহ কর্তৃপক্ষে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিও থেকে যাবে। তাই তাড়াহুড়ো না করে, সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে উন্মুক্ত আলাপ আলোচনার প্রেক্ষিতেই এধরণের স্পর্শকাতর ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে টিআইবি আশা করে।
সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে অনলাইন গণমাধ্যমকে অবারিত ও উন্মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরে ড. জামান আরো বলেন, অনলাইন গণমাধ্যমের নামে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের সুযোগ রোধ করুন। পাশাপাশি অনলাইন মাধ্যমে মুক্ত সাংবাদিকতার পথটাও উন্মুক্ত রাখুন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের কষ্টার্জিত অধিকার ভুলুন্ঠিত করবেন না। অন্যথায় ‘অবাধ তথ্য প্রবাহ’, ‘স্বাধীন মত প্রকাশ’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এসব শব্দমালা শুধু কাগুজে ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকবে, যা কোন কল্যাণকামী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচয় হতে পারেনা।
তথ্য মন্ত্রণালয় প্রচলিত আইনের আওতায় প্রকাশিত পত্রিকা ও টেলিভিশনের অনলাইন পোর্টালগুলোর জন্য পৃথক নিবন্ধনের নির্দেশ অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের হীন পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তথ্যের অবাধ প্রবাহের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক ধারাসমূহ বাতিল করাসহ আরো কার্যকর ও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করে টিআইবি। পাশাপাশি ভুঁইফোঁড় অনলাইন পোর্টাল ও সাংবাদিকতা চর্চার বিপরীতে ব্যক্তিস্বার্থে প্রকাশিত নামসর্বস্ব কথিত অনলাইন মাধ্যম ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ মসৃণ করবে।