বাংলাদেশে ‘অব্যাহত’ গুমের বিরুদ্ধে ১২ মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতি
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বলপূর্বক গুম অব্যাহত রেখেছে। সাথে থাকছে দায়মুক্তি। এসব ক্ষেত্রে টার্গেট মূলত সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী ও সরকারের সমালোচকরা। ৩০শে আগস্ট বলপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার মানুষের জন্য উৎসর্গকৃত আন্তর্জাতিক দিবসকে সামনে রেখে এক যৌথ বিবৃতিতে শনিবার এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহ ১২টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠন। দিবসটি উপলক্ষে গুমের শিকার মানুষজনকে স্মরণ করার পাশাপাশি, বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে জোরপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার মানুষের পরিবারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে সংগঠনগুলো।
বিবৃতিতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩১শে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে কমপক্ষে ৫৭২ জন গুম হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এদের কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে। কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আবার অনেককে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
কিন্তু অনেকেই আছেন যারা এখন কোথায় বা কী অবস্থায় আছেন, তার কোনো খোঁজ নেই।
রাষ্ট্রের এজেন্টরা কোনও ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণের পর তাকে হেফাজতে রাখলেও, তার খোঁজ বা অবস্থান গোপন রাখা হলে, তাকে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। আন্তর্জাতিক আইনে এই কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে গুমের ঘটনা ঘটেছে এমন ধারাবাহিক ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকলেও, বাংলাদেশ সরকার গুমের এই বেআইনি চর্চার কথা অস্বীকার করে আসছে। গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গ ও তাদের পরিবারের বিচার প্রাপ্তির পথ পদ্ধতিগতভাবে রুদ্ধ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, বাকস্বাধীনতার ওপর শাসক দলের অব্যাহত দমনপীড়নের অংশ হলো এই গুম। সমালোচকদের স্তব্ধ করতে বা বিরোধী দলগুলোকে দমিয়ে রাখতে গুম বা গুমের হুমকিকে ব্যবহার করা হয়।
জাতিসংঘের বলপূর্বক ও অনিচ্ছায় অন্তর্ধান বিষয়ক কার্যকরি গ্রুপ (ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অ্যান্ড ইনভলান্টরি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) ও জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটি ও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি বাছবিচারহীন গ্রেপ্তার, কাউকে আটকের কথা স্বীকার না করা ও গুমের বিষয়ের তথ্য প্রকাশে বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
গুম হওয়া মানুষের পরিবার-স্বজনরা বারবার তাদের প্রিয়জন গুম হওয়ার ঘটনায় বারবার তদন্তের আহ্বান জানালেও, বাংলাদেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গ ও তাদের স্বজনরা আইনি প্রতিকার চাইতে গেলে নানারকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। তাদের মামলা নিতে সম্মত হয় না পুলিশ। মামলা হলেও, তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়। বিশেষ করে বিরোধী দলের সদস্য, ক্ষমতাসীন সরকার ও শাসক দলের সমালোচকদের জন্য এটি আরও বেশি হয়।
এছাড়াও বেআইনি কর্মকাণ্ড ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে বা স্রেফ গুম হওয়া ব্যক্তির খোঁজ নিতে গেলে তাদের পরিবার সরকারি কর্তৃপক্ষ থেকে ভয়াবহ হুমকি ও হয়রানি করা হয়। অপরদিকে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীগুলো দায়মুক্তি ভোগ করে, কেননা শাসক দল এই গুমের ঘটনা স্বীকারই করতে বা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে রাজি নয়।
বাংলাদেশে যে গুম হয়, তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে আসছে। গুমের ঘটনা বিশ্বাসযোগ্যভাগে তদন্ত করতেও সম্মত নয় সরকার। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘণের প্রতিকার করার যেই দায়িত্ব রয়েছে সরকারের—এই ধরণের আচরণ সেই দায়িত্ব পরিত্যাগের শামিল বলেও মন্তব্য করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
বিবৃতিতে বলা হয়, অতীতেও গুমের ঘটনা ঘটেছে। তবে ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই গুমের চর্চা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধী দলের বহু সদস্য ও সমর্থক ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেপরে গুমের শিকার হয়েছে। ওই নির্বাচন বড় বিরোধী দলগুলো বয়কট করেছিল। এতে ক্ষমতায় ফিরে আওয়ামী লীগ জোট।
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে আগেও কমপক্ষে ৯৮ জনের গুম হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়। গুম সহ বিরোধী দলের ওপর নানা ধরণের আক্রমণের কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিনা, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন।
কভিড-১৯ মহামারি চলার সময়ও গুম অব্যাহত রয়েছে। এই মহামারির কারণে যেই অর্থনৈতিক দুর্দশা, তা গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের পরিবারের মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক সুস্থতার ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। কারণ, গুম হওয়া ব্যক্তিরাই অনেকক্ষেত্রে পরিবারের আয়-রোজগারের উৎস ছিলেন। এছাড়া গুম হওয়া স্বজনকে খোঁজা অব্যাহত রাখার সামর্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এক্ষেত্রে লকডাউন ও আদালতের কার্যক্রম সীমিত হওয়াও প্রতিকার বিলম্বিত করতে ভূমিকা রাখছে।
গুম থেকে সকল মানুষের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সংবিধিতে স্বাক্ষর বা র্যা টিফাই করেনি বাংলাদেশ সরকার। ওই সংবিধিতে গুমের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে: “রাষ্ট্রের এজেন্ট বা রাষ্ট্রের অনুমতি, সমর্থন সমেত বা জ্ঞাতসারে একদল ব্যক্তি যখন কাউকে গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ বা অন্য কোনোভাবে তার স্বাধীনতা হরণ করে; এরপর তার স্বাধীনতা হরণের বিষয়টি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায়, বা তার অবস্থান বা খোঁজ গোপন রাখে, যার ফলে ওই ব্যক্তি আইনের সুরক্ষার আওতায় থাকেন না”—তখন ওই ঘটনাকে গুম বলা হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, গুম আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘণ। তবে যখন বেসামরিক মানুষের ওপর ব্যাপক বা সামগ্রিক আক্রমণের অংশ হিসেবে গুম করা হয়, তখন এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য বাংলাদেশ। মানবাধিকার কাউন্সিলের উচিৎ বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে সংঘটিত সকল গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্বাধীন তদন্তের দাবিতে একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করা।
সর্বোপরী রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা গায়েব হওয়া সকল মানুষকে তাদের পরিবারের নিকট নিরাপদে ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ। এসব গুমের জন্য দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিৎ।
এই যৌথ বিবৃতিতে অনুসমর্থনকারী সংগঠনগুলো হলো, অ্যাডভোকেটস ফর হিউম্যান রাইটস, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইন্সট ইনভলান্টরি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন্স, এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, মায়ের ডাক, অধিকার, রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইন্সট টর্চার।