স্বজনদের ফিরে পেতে আর কত অপেক্ষা?
গুম হওয়া অনেকের ঠিকানা হয় কারাগারে। খবর পেয়ে স্বজনরা ছোটেন সেখানে। কেরানীগঞ্জ কারাগারের প্রবেশপথে কয়েদির সাথে সাক্ষাতের জন্য স্বজনদের ভিড়। করোনাকালে দেখা হওয়ার নিশ্চয়তা না থাকা সত্ত্বেও সন্তান কোলে স্বামীকে এক নজর দেখতে অধীর অপেক্ষায় এক নারী: নাসিম সিকদার –
বাবার জন্য সন্তান কাঁদছে, সন্তানের জন্য কাঁদছে মা। স্বামীর জন্য স্ত্রী কাঁদছে, ভাইয়ের জন্য ভাই। কারো আপনজন কয়েক বছর আগে কারো বা হারিয়েছে কয়েক মাস হলো। নিখোঁজ মানুষগুলোর জন্য পরিবারের সদস্যদের শুধু কান্না আর কান্না। হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের ফিরে পেতে আর কত অপেক্ষা করতে হবেÑ এমন প্রশ্নই আজকের আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে স্বজন হারানো মানুষগুলোর। দিবসটি উপলক্ষে ফেনীর মাহবুবুর রহমান রিপনের স্বজনরা বলছেন, আমাদের কারো প্রতি কোনো অনুযোগ, অভিযোগ নেই। শুধু আমাদের পরিবারের সদস্যকে ফেরত চাই।
সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হচ্ছে আজ। ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির সুরাহার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স এই আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়। তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়।
২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ৩০ আগস্ট গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং সেইসাথে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আর গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীর পাশাপাশি আছে সাধারণ লোকজনও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। যার ফলে গুমের হাত থেকে সুরাহা পাওয়ার অধিকারটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয় এবং কাউকে গুম করে দেওয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পায়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য মতে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ১৯৭০ ও ’৮০-এর দশকে কেবল অবৈধ অস্ত্র কারবারি ও ভিন্নমতাবলম্বীরাই গুম হতো; কিন্তু বর্তমানে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, মাদক কারবারি ও মানব পাচাকারীদের মধ্যেও গুমের ঘটনা দেখা যায়।
জানা গেছে, দেশে ২০০৭ থেকে চলতি বছরের গত ২৫ আগস্ট পর্যন্ত গত ১৪ বছরে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছে। অন্যদের ভাগ্যে কি হয়েছে আজো জানে না নিখোঁজদের স্বজনরা। তবে সব গুমের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)। আসক গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা, প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছে। একইসাথে গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করে গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছরে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক, উদ্বেগ আর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। আসক কর্তৃক বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ (আগস্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ও ৫৭ জন ফেরত এসেছে। এসব ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন যে, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।
পল্লী চিকিৎসক মোখলেসুরের বাবা আবদুর রশিদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট সন্দেহবশত থানা পুলিশ আমার ছেলেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তিন দিন থানায় ছিল। থানায় পুলিশের মাধ্যমে খাবারও দিয়েছি। পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে আকুতি করে বলেছিল, সে কোনো দল করে না। কোনো উগ্রবাদেও বিশ্বাস করে না। পুলিশ আমাকে চাপ দিতে থাকে যে, তার ছেলে যাতে পুলিশের কাছে স্বীকার করে সে সরকারবিরোধী কাজে জড়িত। স্বীকার না করলে করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। আমাকে গালাগাল করা হয়। কিন্তু আমার ছেলে অন্যায় স্বীকারোক্তি দেয়নি। তিন দিন পর থানার ওসি আলতাফ জানান যে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্যস্থানে পাঠানো হয়েছে। সেই যে পাঠানো হলো আর ফিরে আসেনি আমার ছেলে।
রাজধানীর রামপুরা থেকে নিখোঁজ ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা সালেহা বেগম বলেন, আমার ছেলে তিন বছর সাত মাস ধরে নিখোঁজ। যুবলীগের স্থানীয় নেতারা প্রশাসনকে দিয়ে আমার ছেলেকে গুম করে। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেতে হাজারও মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গেছি। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু আজো আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। আর কত দিন আমি ছেলের অপেক্ষায় থাকব, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন সালেহা বেগম।
ফেনীর মাহবুবুর রহমান রিপনের মা রওশন আরা বলেন, আমার ছেলে ২০১৪ সালের মার্চের ২০ তারিখে রাতের আঁধারে আমার বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে কালো পোশাকধারীরা চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। যখন রিপনকে ধরে নিয়ে যায়, তখন তার একটি শিশু বাচ্চা রেখে যায়। মামলা করতে গিয়েছি। তারা মামলাও নেয়নি। আজো আমি ছেলেকে ফেরত পাইনি। কোনো বিচারও পাইনি।
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পল্লবী এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তৎকালীন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে (৩১) ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তাকে আর পাওয়া যায়নি। গতকাল পিন্টুর বোন রেহেনা বেগম বলেন, ‘ছেলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমাদের বাবা গত ২২ এপ্রিল হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আমরা আমাদের ভাইকে ফিরে পেতে এখনো অপেক্ষা করছি। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি যে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন।’
২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি র্যাবের পোশাক পরিহিত একটি টিম তুলে নিয়ে যায় বিএনপি নেতা সাদেকুলকে। সাদেকুলকে খুঁজে বের করতে র্যাব-৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু আজো সাদেকুলকে ফেরত পায়নি তার পরিবার।
২০১৬ সালের ৯ আগস্ট রাতে জামায়াতের সাবেক নেতা মীর কাসেম আলীর ছোট ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে মিরপুরের ডিওএইচএস এর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের অভিযোগ, ওইরাত সোয়া ৯টায় ছয়-সাতজনের সাদা পোশাকের একদল লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ব্যারিস্টার আরমানের মিরপুরের ডিওএইচএসের বাসায় যায়। এ সময় আরমান দরজা খুললে তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় ওই অজ্ঞাত লোকজন। পরিবারের সদস্যরা কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে কি না জানতে চাইলে তারা কোন জবাব দেননি। এরপর থেকেই আরমান নিখোঁজ। আরমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী ছিলেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন ডিফেন্স ল ইয়ার ছিলেন।
একই বছরের ২২ আগস্ট রাজধানীর মগবাজারের বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে (৫৭)। তার মা আফিফা আযম ওই সময় অভিযোগ করেছিলেন, ২২ আগস্ট রাত অনুমান ৯ ঘটিকার সময় রমনা থানার বড় মগবাজারের ১১৯/২ কাজী অফিস লেনের বাসা থেকে ২০-৩০ জন লোক তার ছেলেকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে। সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন তিনি।
পল্লবী থানার যুবদল নেতা নুরে আলমের স্ত্রী বীণা বেগম বলেন, ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের বাসা থেকে পুলিশের লোকজন তার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু থানা ও ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দফতরে গিয়েও আজ পর্যন্ত তার স্বামীর খোঁজ পাননি। তার স্বামী গুম হওয়ার পর পুলিশ তার দুই ছেলেকে কয়েকবার ধরে নিয়ে গেছে। এরপর টাকা দিয়ে ছেলেদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটছে। স্বামীকে এখনো পাইনি। ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে র্যাব ধরে নিয়ে যায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মোকাদ্দেসকে। আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ মেলেনি। র্যাবও স্বীকার করেছে না। আল মোকাদ্দেসের চাচা আবদুল হাই বলেন, আল মোকাদ্দেসকে র্যাব তুলে নিয়ে গেছে এর প্রমাণ তার কাছে আছে।
২০১০ সালের ১ মার্চ দক্ষিণখান থানা এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ছাত্রদল নেতা মানিককে। আজো মানিকের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মানিকের ভাই বলেন, ‘আমাদের কান্না কেউ শোনে না।’
২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি নিউমার্কেট থানা এলাকা থেকে গুম হয় ছাত্রদল নেতা মাহবুবুর রহমান বাপ্পী। এর কিছুদিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। বাপ্পির বোন বলেন, ‘আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমাকেও ধরে নিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। আমাকে ছয় মাস জেলে থাকতে হয়েছে। প্রথমে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়। আমার বাবা এই শোক সহ্য করতে না পেরে হার্ট অ্যার্টাক করে মারা গেছে।’