দুর্নীতির অবাধ বিস্তার
‘দুই হাজার কোটি টাকা পাচার : ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রেপ্তার’ এটি সাম্প্রতিককালের একটি সংবাদ শিরোনাম। ভেতরের খবর বেশ চমকপ্রদ। গত ১৬ জুন রাতে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাড়িতে হামলার আগে পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। সুবল সাহার অজ্ঞাতনামা আসামিরা জ্ঞাত হয়ে যায় মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই। ৭ জুলাই সেই হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ওই সময়ের শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং তার ভাই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলকে। শুধু তখনই সিআইডির তদন্তে বের হয়ে আসে তাদের কোটি টাকা অবৈধ আয় এবং তা পাচারের কথা। আর তাদের কথার সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীমের এই অর্থপাচারের সংশ্লিষ্টতা। গ্রেপ্তার করা হয় তাকেও।
ভেবে দেখুন, আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতির বাড়িতে যখন একই দলের শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক হামলা করলেন, তখনই কেবল সক্রিয় হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বেরিয়ে এলো এত বড় দুর্নীতির কথা। সুবল সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনা না ঘটলে হয়তো কোনো দিনই আমরা জানতেও পারতাম না যে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের এত ছোট একটা ইউনিটের নেতারা পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করতে পারেন! আমরা জানতে পারতাম না, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি বা ‘জিএফআই’ যে বলছে বাংলাদেশ থেকে বছরে অন্তত এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়, সেখানে জেলাপর্যায়ের একজন ছাত্রলীগ নেতারও সামান্য অবদান আছে।
ঘুষ-দুর্নীতির ৮০ লাখ টাকা বাসা থেকে উদ্ধারের ঘটনায় সম্প্রতি ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপালের নামে চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। গত বছর চট্টগ্রাম কারাগারের দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে সন্দেহের তালিকায় পড়ে যান ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল। দুদক তার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। তার বাসায় পাওয়া যায় ৮০ লাখ টাকা।
আওয়ামী লীগ নেতা সাহেদ যখন করোনার টেস্ট জালিয়াতির ঘটনায় ধরা পড়েন, তখনই শুধু বেরিয়ে আসে সে কত বড় জালিয়াত ও দুর্নীতিবাজ ছিল। যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়া ফাইভস্টার হোটেলে বছরের পর বছর তার পাপের সাম্রাজ্য চালিয়ে যেতে পারেন। কত রথী-মহারথী তার ‘মেহমান’ হয়ে আসছিলেন। তখন তাকে কেউ ধরেনি। যখন ক্ষমতাধরদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সে, তখনই জানা যায় পাপিয়ার ফাইভস্টার রংমহলের কথা! সবার চোখের সামনে একটি থানাপর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা এনু-রুপন দুই ভাই রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেলেন। কেউ দেখল না। যখন ক্যাসিনো-কান্ডে সম্পৃক্ত তার বিষয় সামনে এলো, তখন তাদের বাসায় আবিষ্কৃত হয় সোনার খনি ও টাকার পাহাড়! বাসায় নগদ টাকাই মেলে প্রায় ২৭ কোটি। সোনা বেশুমার। আরও ছিল বিভিন্ন দেশের মুদ্রা। তার পরিমাণও নেহাতই কম নয়। যুবলীগ নেতা সম্রাট, জি কে শামীমের বেলায়ও ঘটে অভিন্ন ঘটনা। এমনকি ২০০৫ সালে মাসে ৫ হাজার টাকা বেতনে যোগ দেওয়া যুবলীগ অফিসের পিয়ন আনিস ২০১২ সালে উপ-দপ্তর সম্পাদক ও পরে দপ্তর সম্পাদক হয়ে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে হয়ে যায় দামি গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, পেট্রলপাম্পসহ কত কিছুর মালিক। এগুলোও নিশ্চয়ই কারও অলক্ষ্যে হয়নি। কিন্তু ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের আগে বছরের পর বছর সবকিছু করতে পেরেছে নির্বিঘ্নেই।
এই সংবাদগুলো বলে দেয়, দেশে যে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে, তা নিয়ন্ত্রণে কারও কোনো খবরদারি নেই। যখন মাত্র গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ে, তাতেই এই অবস্থা! সংবাদমাধ্যম যেটুকু প্রকাশ করতে পারছে, তাতেই এটা স্পষ্ট যে, দেশের প্রতিটি সেক্টরে চলছে চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতির মহোৎসব। রাজনৈতিক পরিচয় মিলিয়ে দেখলে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দল বা সরকারের লোকজন। এই দেশে সরকারি কেনাকাটায় ৩২০ টাকার বইয়ের দাম ৮৩ হাজার টাকা দেখানোর নজির আছে। একটা আইসিইউর পর্দার দাম সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা দেখিয়ে সাগর চুরির নজিরও আছে। একটা বালিশ বিল্ডিংয়ের ওপরে বাসায় ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে সাত হাজার টাকা। করোনা মহামারীকালে একটা ৫০০ টাকার গগলসের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা, একটা বঁটি-দায়ের দাম দেখানো হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
সর্বশেষ বড় ধরনের লুটপাটের খবরটি সামনে এনেছে দৈনিক প্রথম আলো। ২৩ আগস্ট ২০২০ পত্রিকাটি লিখেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার প্রকল্পে যে ধরনের খরচ দেখানো হয়েছে, তা বালিশ-কান্ড, পর্দা-কান্ড, গগলস-কান্ড, বঁটি-দা-কান্ডকেও হার মানিয়েছে। এতে অতিথি বসার জন্য একটি চেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ছয় লাখ টাকা। এমন দামের চেয়ারের কথা বাংলাদেশের ফার্নিচার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কেউ কখনো শোনেননি। বাংলাদেশে একটি চেয়ারের দাম সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। দুধে কী পরিমাণ পানি আছে, তা মাপার একটি যন্ত্রের দাম ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এমন ৩০০ সেট যন্ত্র কিনতে ব্যয় হবে ৯ কোটি ৯৬ হাজার টাকা। কিন্তু এ ধরনের যন্ত্রের দাম মাত্র ৬০ থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা। একইভাবে একটি বর্জ্য রাখার পাত্রের দাম আড়াই লাখ টাকা। স্কুলে স্কুলে দুগ্ধজাত পণ্য প্রদর্শনীর জন্য ব্যয় সাড়ে ১০ লাখ টাকা। গাভি গর্ভবতী কি না তা পরীক্ষার জন্য ৬৫ ইউনিট কিট কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রতিটি কিট ২৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা। অথচ ১ হাজার পিসের প্রতিটি ইউনিট কিটের দাম ৯০০ থেকে ৫ হাজার টাকা। এই তালিকাটা আরও দীর্ঘ। তবে উল্লিখিত কয়েকটি দেখেই ধারণা করা যায়
৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার মধ্যে কত টাকা চুরির বন্দোবস্ত পাকা হয়ে গেছে। চোরদের জন্য সুখবর হলো, এই এই কেনাকাটার দর প্রস্তাব আরও আগেই মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়ে গেছে।
এই যখন দেশের দুর্নীতির সামান্য চিত্র, তখন এর দায়ও সরকার চাপিয়ে দিয়েছে বিএনপির ওপর। বিএনপি ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে ১৪ বছর আগে। তাদের রোপণ করা দুর্নীতির গাছ এক যুগ ক্ষমতায় থেকেও সরকার কেন উপড়ে না ফেলে সার-পানি দিয়ে সেটাকে মহিরুহে পরিণত করে তার সুমিষ্ট ফল ভোগ করছে, সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো জানা যাবে না।
বাংলাদেশে দুর্নীতি কবে ছিল না? সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বাইরে উল্লেখ করার মতো কোনো শক্তি ছিল না। সে পরিস্থিতিতে দুর্নীতি যে জেঁকে বসতে শুরু করেছে, তা টের পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল ১৬ জন এবং ৯ এপ্রিল ও ২২ সেপ্টেম্বর আরও ২৬ জন মিলিয়ে ৪২ জন এমপিকে দুর্নীতির অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে (মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী : ইতিহাসের পুনঃপাঠ, আলতাফ পারভেজ, পৃষ্ঠা-৪২২)। তাতেও কাজ হয়নি। একপর্যায়ে রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে তিনি বলেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক সত্য, ‘দেশ স্বাধীন করলে সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে চোর, বাঁয়ে চোর, সামনে চোর, পেছনে চোর, চোর আর চোর। আমি বিদেশ থেকে যা কিছু আনি এই চোর চাটার দল সব খাইয়া ফেলায়। সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনছি, অথচ আমি আমারটাও পেলাম না।’ আরেকবার তিনি সেই চোরের দলের দৌরাত্ম্য নিয়ে এও বলেছিলেন, ‘এদের জিহ্বা যে কত বড়, সে কথা কল্পনা করতে আমি শিহরিয়া উঠি। এই চোরের দল বাংলার মাটিতে খতম না হলে কিছুই করা যাবে না। আমি যা আনব এই চোরের দল খাইয়া শেষ করে দেবে। এই চোরের দলকে বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে।’ এর মানে হলো, এই দেশে সেই শুরু থেকেই চোরের রাজত্ব ছিল। সেটা কখনো বাড়ে, কখনো একটু কমে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার আমলের চুরির দায় আগের আমলের সরকারের ওপর চাপিয়ে দেননি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে দুর্নীতির অভিযোগ কম থাকলেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। নব্বই-পরবর্তী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কেউই দুর্নীতির অভিযোগমুক্ত নয়। তবে বর্তমানে দুর্নীতি যে আগের সব আমলকে ছাড়িয়ে গেছে, সেটা সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টগুলো দেখলেই ধারণা করা যায়।
মানুষ আর এই তুলনা, দোষারোপ ও দায় চাপানোর রাজনীতি দেখতে চায় না। অতীতে যারা দুর্নীতি করেছে তার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে বিচার করার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি বর্তমানের এই ভয়াবহ দুর্নীতি রোধ ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের দায়িত্বও তাদের ওপরই বর্তায়।
লেখক সায়ন্থ সাখাওয়াৎ | চিকিৎসক ও কলামনিস্ট