আবরারকে প্লাস্টিকের মোটা দড়ি দিয়ে পেটায় মুজাহিদ

0

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার শিকার হওয়ার আগে শেষ চার ঘণ্টার নির্মম নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে আদালতে আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কে কীভাবে তার ওপর বর্বরতা চালিয়েছে তা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। সর্বশেষ গতকাল আবরার হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এর আগে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বুয়েটের ছাত্র ইফতি মোশাররফ সকাল, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন ও অনিক সরকার। 

এই চার আসামির জবানবন্দি অনুসারে, ৪ অক্টোবর বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে মেসেঞ্জার গ্রুপে উত্তর দেয় বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহা। গ্রুপে সে লেখে, ‘ওকে (আবরার) বাড়ি থেকে ফিরতে দেন।’ এক দিন পর ৬ অক্টোবর বিকালে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া থেকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ফেরেন আবরার। ৮ অক্টোবর রাত ৮টা ১৩ মিনিটে আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যায় তানিম, সাদাত, সাইফুল ও অভি। আবরারের দুটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপও সঙ্গে নেওয়া হয়। আবরারের দুটি মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করতে থাকে মুজতবা রাফিদ ও খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর। মুনতাসির আল জেমি নেয় ল্যাপটপ। এ সময় কক্ষে আসে মেহেদী হাসান এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন। বুয়েট ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মেহেদী কারা কারা শিবির করে তা জানতে চেয়েই কয়েকটি চড় মারে আবরারকে। তখন ইফতিও চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। একপর্যায়ে শামসুল আরেফিন ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে আসে। কথা আদায়ের জন্য ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারের পায়ে পেটায় তারা। এরপর দুই হাত টানটান করে স্টাম্প দিয়ে আবরারকে মারতে থাকে অনিক। আবরার চিৎকার করে কাঁদতেও পারেননি। কারণ অন্যরা আবরারের মুখ চেপে ধরে রেখেছিল। এভাবে থেমে থেমে স্টাম্প দিয়ে পেটায় ইফতি, মেফতাহুল জিয়নসহ অন্যরা। মারতে মারতে ইফতির হাতে থাকা স্টাম্পটি ভেঙে যায়। এরপর অনিক সরকার আরেকটি স্টাম্প নিয়ে আবরারের হাঁটু, পায়ের তালু এবং পা ও বাহুতে মারতে থাকে। এ সময় ভয়ে আবরার কয়েকজনের নাম বলে। তখন আবরারকে চড় মারে মেফতাহুল এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দিতে থাকে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আবরারকে কক্ষে রেখে ইফতি, জিয়নসহ অন্যরা ক্যান্টিনে খেতে যায়। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে তারা দেখে, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। মেঝে থেকে আবরারকে ধমকিয়ে টেনে-হিঁচড়ে দাঁড় করায় ইফতি। গালে কয়েকটি চড় মারে সে। মুজাহিদ তখন কক্ষে থাকা প্লাস্টিকের মোটা দড়ি দিয়ে পেটাতে থাকে আবরারকে। ইফতি আবার স্টাম্প হাতে নেয়। এবার আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করে সে। তাবাখখারুল তখন চড়-থাপ্পড় মারে। ততক্ষণে রাত ১১টা। কক্ষে ফের আসে অনিক সরকার। এসেই স্টাম্প দিয়ে একনাগাড়ে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে আবরারকে। টানা দেড়শ বারেরও বেশি স্টাম্প দিয়ে আবরারকে আঘাত করে অনিক। বাঁচার জন্য আবরার একাধিকবার পা জড়িয়ে ধরেন অনিকের। কিন্তু অনিক আরও জোরালোভাবে পেটাতে থাকলে আবরার আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠেন। ওই সময় কক্ষে উপস্থিত সবাই ভয় পেয়ে যায়। আসামিদের কয়েকজন বিছানার ওপর জড়সড় হয়ে বসে। কিন্তু অনিকের পেটানো আর থামে না। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আবরারকে পিটিয়ে কক্ষ থেকে বের হয় অনিক। রাত তখন ১২টা। আবরার ওই সময় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি করে পর পর দুবার। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না আবরার। অবস্থা বেগতিক দেখে মেঝেতে আবরারের মাথার নিচে বালিশ দেয় ইফতি। চিন্তিত ইফতি ফোন করে অনিককে। বেপরোয়া অনিক প্রতিউত্তরে বলে, ‘কিচ্ছু হবে না। আবরারকে গোসল করিয়ে হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে দাও।’ কিন্তু ততক্ষণে আবরার মৃতপ্রায়। ফের বমি করেন আবরার। তখন আবরারকে দাঁড় করানোও যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে কয়েকজন ধরে তাকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেয়। এ সময় সেখানে আসে মেহেদী ও অনিক। তখন মেহেদী বলে, ‘ও ঢং ধরেছে। ওর কিছু হয়নি। থেরাপি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’ এ সময় আরও মেরে তথ্য বের করতে বলে অনিক। ঠিক ওই মুহূর্তে এসএমএস পাঠায় অমিত। সেও একইভাবে আরও তথ্য বের করতে আবরারকে মারার বুদ্ধি দেয়। কিন্তু আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাকে হল থেকে বের করে দিতে বলে। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলে। আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করা হয়। এ সময় মিজান পানি আনতে বললে পানি এনে আবরারকে খাওয়ানো হয়। পরে তোশকে করে মোয়াজ, তামিম ও জেমি দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি রাখে আবরারকে। তখন আবরার গোঙানির সুরে বলেন, ‘আমার খুব খারাপ লাগছে।’ ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন দেয়। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসককে নিয়ে আসে। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে।’ আবরারকে সিঁড়ির কাছে নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, শিবির বলে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেওয়া। পুলিশও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু মারা যাওয়ায় আবরারকে পুলিশে দেওয়া সম্ভব হয়নি। আবরার যখন মারা যান তখন রাত ৩টা। পরে আবরারের লাশ রাখা হয় ক্যান্টিনে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে আবরারের মরদেহ উদ্ধার করে চকবাজার থানা পুলিশ। 

পরদিন সন্ধ্যায় ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবরার হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার ১৯ জনকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে পায় ডিবি। এদের মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে কারাগারে রয়েছে। এ ছাড়া গতকাল ছয়জনের রিমান্ড শেষে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com