সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যু, দুর্নীতিবাজ ও মাদক ব্যবসায়ীরা সাবধান’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘যার যেখানে অবস্থান, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, জুয়াড়ি, ভূমিদস্যু, টেন্ডারবাজ, দুর্নীতিবাজ ও মাদক ব্যবসায়ীরা সাবধান। শেখ হাসিনার এ্যাকশন শুরু হয়েছে, এই এ্যাকশনের টার্গেট থেকে কোনো অপকর্মকারী রেহাই পাবে না।’ রবিবার বিকেলে রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজশাহী বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম নিজের দলের ভেতর থেকেই শুদ্ধি অভিযানের মতো সৎ সাহস দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজের দলের অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার মতো সাহস এদেশের আর কোনো শাসক অতীতে দেখাতে পারেন নি। হাওয়া ভবন বলেন, খাওয়া ভবন বলেন, আজ যারা বড় বড় কথা বলেন, গলাবাজি করেন তাদের কেউই নিজ দলের অপকর্মে লিপ্তদের বিচার করতে পারেন নি, শাস্তি দেয়ায় সৎ সাহস দেখাতে পারেন নি। তা পেরেছেন কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
আওয়ামী লীগের নামে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্তদের সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘কেবল ঢাকা নয়, সারাদেশেই শুদ্ধি অভিযান চলছে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যু ও মাদক ব্যবসায়ীরা কেউ এ অভিযান থেকে রেহাই পাবে না। বঙ্গবন্ধু আইন করে নিষিদ্ধ করলেও জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর ক্যাসিনো, মদ, জুয়ার বৈধতা দিয়েছিলো।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ্য করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনি বলেছেন, সরকার এখন খাদের কিনারে! আমি বলতে চাই, মির্জা ফখরুল সাহেব, আজকে বড় বড় কথা বলেন। বুকে হাত দিয়ে বলুন, হাওয়া ভবন, খাওয়া ভবন, লুটেরা ভবন, সারা বাংলাদেশকে লুট করেছেন। খুনে খুনে বাংলাদেশ রক্তনদী হয়ে গেছে। লাশে লাশে বাংলাদেশ, লাশের পাহাড় হয়ে গেছে। বিচার কি হয়েছে? শাস্তি কি কেউ পেয়েছে? আপনারা হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে যে দলকে নিঃশেষ করতে পারেন নি, সেই দল কখনো খাদের কিনারে যেতে পারে না। বরং আন্দোলনে ব্যর্থ, নির্বাচনে ব্যর্থ, স্বৈরাচারী ও স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষক বিএনপিই এখন খাদের কিনারে অবস্থান করছে।’
ক্যাসিনো প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আজকে ক্যাসিনোর কথা বলেন, গডফাদারের কথা বলেন। এসবের সৃষ্টি কারা করেছে? বঙ্গবন্ধু মদ, জুয়া আইন করে বন্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সেটা চালু করেছেন। এ জুয়ার স্রষ্টা হচ্ছেন আপনারা। ড্রাগের দিকে এ দেশের তরুণদেরকে ঠেলে দিয়েছেন আপনারা। বড় বড় কথা বলেন কোন মুখে!’
আওয়ামী লীগের নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব নিয়ে দলের সম্পাদক বলেন, ‘ঘরের মধ্যে ঘর করবেন না। মশারির মধ্যে মশারি খাটাবেন না। দুঃসময়ের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে আওয়ামী লীগ টিকে থাকতে পারে না। আজকে বসন্তের কোকিলরা যদি দলের নেতৃত্ব নেয়, তারা যদি প্রাধান্য পায়, আবারো দুঃসময় আসতে পারে। আবারো দুর্যোগ আসতে পারে। আবারো অমানিশা আসতে পারে। সে সময় হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বালিয়েও এই সুবিধাবাদি অপকর্মকারীদের খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘খারাপ লোকের আমাদের দরকার নেই। ক্লিন ইমেজের পার্টি দরকার, আগামী জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে আমরা আমাদের দলকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মডেলে ঢেলে সাজাতে চাই। আমরা ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই সারাদেশে। খারাপ ইমেজের লোক, যাদের ভাবমূর্তি নেই, এই সব লোকদের দলে টেনে পাল্লা ভারি করে কোনো লাভ নেই। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। আমার দুষ্টু গরুর দরকার নেই।’
আগামী জাতীয় কাউন্সিলের আগেই সকল মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন করার তাগিদ দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জাতীয় কাউন্সিলের আগেই তৃণমূলের মেয়াদ উত্তীর্ণ সকল কমিটি করতে হবে। এ নিয়ে কারও গাফিলতি সহ্য করা হবে না। যারা পদ পেয়ে ছাড়তে চান না তারা মনে রাখবেন আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা ছাড়া আমরা কেউই অপরিহার্য নয়। কোনো পদ কারও কাছে লিজ দেওয়া হয়নি। পরিষ্কার বলে দিতে চাই, আজকে প্রভাব খাটাবেন, জোর করে পদ দখল করে রাখবেন, মনে হয় যেন মৃত্যুর আগে পদ ছাড়বেন না। এ রকম লোকও আছেন। আমরা স্মার্ট আওয়ামী লীগ চাই। আরও আধুনিক আওয়ামী লীগ চাই, বিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ চাই। দূষিত রক্ত চাই না। দূষিত রক্ত বের করে দিয়ে আবার আওয়ামী লীগের সকল পর্যায়ে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করতে হবে।’
এখনও ষড়যন্ত্র চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘যারা আন্দোলনে ব্যর্থ, নির্বাচনে ব্যর্থ তারা দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র করছে। অথচ বাংলাদেশে গত ৪৪ বছরে সবচেয়ে যোগ্য, সৎ ও সফল নেতা শেখ হাসিনা যিনি মৃত্যু মেশিনে দাঁড়িয়ে জীবনের গান গান। যিনি মৃত্যুকে কখনো পরোয়া না করে দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের দুইজন সেরা রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে শেখ হাসিনা একজন, বিশ্বের তিনজন সৎ সরকার প্রধানের মধ্যে শেখ হাসিনা একজন, বিশ্বের চারজন পরিশ্রমী সরকার প্রধানের মধ্যে শেখ হাসিনা একজন এবং ১০ জন প্রথম সারির নেতার মধ্যে শেখ হাসিনা একজন।’ এর আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে নয়। তবে যারা ছাত্র রাজনীতির নামে অপকর্ম করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। রাজনীতিবীদদের অধিকাংশেরই হাতে খড়ি ছাত্র রাজনীতি থেকে। কাজেই মাথা ব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়।’
রবিবার সকালে একদিনের সরকারি সফরে আসেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রাজশাহী সার্কিট হাউজে তাকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয়। দুপুর ১২টায় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
যুবলীগের চেয়ারম্যান প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘চেয়ারম্যান নজরদারিতে আছে কি না তা পরে জানা যাবে। তিনি আত্মগোপনে নেই। তবে যেসব যুবলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তারা নজরদারিতে আছেন।’
এরপর রাজশাহী সার্কিট হাউসে রাজশাহী বিভাগের সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগদান করেন ওবায়দুল কাদের। সভা শেষে তিনি দলের প্রতিনিধি সভায় যোগ দেন। সেখান থেকে তিনি সরাসরি বিমানযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রাজশাহী ত্যাগ করেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য এবং ১৪ দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক, সাবেক স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে এবং দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, কেন্দ্রীয় সদস্য নুরুল ইসলাম ঠান্ডু, প্রফেসর মেরিনা জাহান ও আমিরুল আলম মিলন। এছাড়া রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, নওগাঁ জেলার সভাপতি আব্দুল মালেক, জয়পুরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান হোসেন, নাটোর জেলার সাধারণ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম শিমুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাইন উদ্দিন মন্ডল, সিরাজগঞ্জ জেলার সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, পাবনা জেলার সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্স ও বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান সভায় বিভিন্ন অভিযোগ এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের চিত্র তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। এছাড়া প্রতিনিধি সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইয়েদ আহমেদ পলক, রাজশাহী বিভাগ থেকে নির্বাচিত দলের সকল সাংসদসহ রাজশাহী বিভাগের সকল জেলা, উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণ উপস্থিত ছিলেন। রাজশাহী জেলার সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান সভায় উপস্থিত থাকলেও কাউকে বক্তব্য দিতে দেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, রাজশাহী জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে যে সমস্যা রয়েছে, আমাগী ৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু এভিন্যুর কার্যালয়ে বসে সমাধান করা হবে।
সভাপতির বক্তব্যে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশে দলের জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে প্রতিটি বিভাগের জন্য পৃথক টিম গঠন করা হয়েছে। দলের জাতীয় সম্মেলনের আগেই প্রতিটি জেলায় প্রতিনিধি সভা তথা সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি পুনর্গঠন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে ইতিমধ্যে অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার হত্যার বিচার করা হয়েছে। একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা চারবার ক্ষমতায় এসেছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে দেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু পরাজিত শক্তি এখনও ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে।’
মোহাম্মদ নাসিম আরও বলেন, ‘একাত্তরে স্বাধীনতার মতো সবচেয়ে বড় অর্জনের পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি। শেখ হাসিনা যত সফল হচ্ছেন, চক্রান্ত ততো বেশি হচ্ছে। কিছুদিন আগে বুয়েটে দুর্বৃত্তদের হাতে আরেকটি অঘটন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কয়েকঘন্টার মধ্যে আবরার ফাহাদের খুনীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তারপরও বিএনপি-জামায়াতের চক্রান্ত থেমে নেই। দ্রুত বিচার আইনে আবরার হত্যার বিচারের ঘোষণার পরও উস্কানী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চক্রান্তকারীরা কখনও সফল হবে না। তাদের পরাজিত করে আমরা আবারও সফল হবো। তবে এ জন্য দলকে, সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আসন্ন জাতীয় সম্মেলনের আগেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা রাজশাহী বিভাগের প্রতিটি জেলায় গিয়ে তৃণমূল নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শুনবো।’
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যায় জড়িত শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক চিহ্নিত জামায়াতি পরিবার থেকে ছাত্রলীগে এসেছে। অন্য অধিকাংশ জড়িতরাও বিএনপি জামায়াত পরিবার থেকে আসা। অতীতে খুন-ধর্ষণসহ বহু অপকর্মের হোতারা এখনও সুযোগ পেলেই অপকর্ম করছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তারা নেই, কিন্তু অপকর্ম প্রমাণ করে তারা আছে।’
দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এমপির দল নয়, দলের এমপি, এ কথা সকল এমপিকে মনে রাখতে হবে। রাজশাহী জেলার সভাপতি ও সেক্রেটারীর সম্পর্ক ভালো নয়। আগামী ৫ নভেম্বর তাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিন্যুর কার্যালয়ে বসে এ সমস্যার সমাধান করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘দলের কমিটিতে আপনজন খোঁজা বাদ দিতে হবে। অন্যথায় আগামীতে আমাদের জন্য প্রচণ্ড দুর্দিন অপেক্ষা করছে।’