মৃত নারীর জাতীয় পরিচয়পত্রে একাধিক ব্যক্তির চালের কার্ড
লাইলী বেগম মারা গেছেন ১০ থেকে ১২ বছর আগে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুহাটী ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের মৃত আব্দুল জলিলের স্ত্রী তিনি। অথচ তার জাতীয় পরিচয়পত্র (৪৪১১৯৫২০৯০৪৯৫) ব্যবহার করে মধুহাটী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের একাধিক ব্যক্তি ১০ টাকা কেজি দরের চাল উত্তোলন করছেন। এক গ্রামের জাতীয় পরিচয়পত্র অন্য গ্রামে ব্যবহার করা হয়েছে। এ ভাবে ওই ইউনিয়নের ১০ জনের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেই অর্ধশত ব্যক্তির নামে এই চালের কার্ড করা হয়েছে।
স্থানীয় চেয়ারম্যান, কতিপয় মেম্বার ও দুই ডিলার বছরের পর বছর ধরে গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত এই চাল নামে বেনামে তুলে নিচ্ছেন। ইউনিয়নের দুই ডিলার নয়ন ও ইন্তা ওজনেও কম দেন বলে উপকারভোগীরা অভিযোগ করেন। সুনিদ্দিষ্ট লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিন তদন্ত করে এই দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে।
এদিকে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর মধুহাটী ইউনিয়নের কুবিরখালী গ্রামের রফিকুল ইসলাম নুরুল ইসলাম ও দুর্গাপুর গ্রামের বদর উদ্দীন লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর চালের কার্ড হারানার গণ জিডি করা হচ্ছে সদর থানায়। দুর্নীতি, অপকর্ম ও একজনের চাল অন্যজন তুলে নেয়ার তথ্য আড়াল করার জন্য এই জিডি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসনাত অভিযোগ তদন্তে রোববার (৭ জুন) মধুহাটী ইউনিয়ন পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি অভিযোগকারীদের বক্তব্য রেকর্ড করেন।
তবে মধুহাটী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফারুক আহম্মেদ জুয়েল বলছেন, ১২৪১ জনের তালিকা করতে গিয়ে কম্পিউটারে টাইপিং ভুল হতে পারে। এগুলো সংশোধন করে বাদ দেয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে তদন্ত করে জানা গেছে, ১০ থেকে ১২ বছর আগে মারা যাওয়া মৃত লাইলী বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে গোপালপুরের আব্দুলের ছেলে আমিরুল, একই গ্রামের রুহুল আমিনের স্ত্রী রেশমা খাতুন, আইয়ুব হোসেনের ছেলে মিন্টু মিয়া, মির্জাপুর গ্রামের ইসমাইলের ছেলে আক্তার হোসেন, নওদাপাড়া গ্রামের বিশারতের ছেলে মোশারেফ, বদর উদ্দীনের ছেলে নুর ইসলাম, কুবির খালী গ্রামের বুদোই মন্ডলের ছেলে কলিম উদ্দীন, একই গ্রামের জাবেদ আলীর স্ত্রী শাহেদা বেগম, ওয়াড়িয়া গ্রামের হালদারের ছেলে সম্ভু হালদার ও একই গ্রামের বদরের ছেলে বাবলুসহ একাধিক ব্যক্তির নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি দরের চালের কার্ড হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে লাইলী বেগমকে মৃত দেখানো আছে। তার জন্ম সাল ১৯৪০। ১০ বছর আগে ইন্তেকালের সময় তার বয়স ছিল ৭০ বছর।
এদিকে মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে চাল পাচ্ছেন লাইলী বেগমের ছেলে আবুল হোসেন আবুও। আবুলের নিজস্ব জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেও তা নেয়া হয়নি। লাইলী বেগমের পরিবার একজন মৃত মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে একাধিক ব্যক্তির নামে চাল তোলার খবরটি শুনে বিস্মিত হন।
মৃত লাইলী বেগমের পুত্রবধূ আকলিমা খাতুন ও নাতি আল আমিন বলেন, এই অন্যায় কাজ যারা করেছে তাদের শাস্তি হোক।
গোপালপুর গ্রামের শুধু মৃত লাইলী বেগমই নন ওই গ্রামের দত্তপাড়ার শচিন্দ্র নাথ দত্তের ছেলে অশোক কুমার দত্ত তিন বছর ধরে ঢাকার গাজীপুর চান্দুরা এলাকায় থাকেন। তার নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চালের কার্ডও রয়েছে। তিনি এই কার্ডে চাল উত্তোলন না করলেও প্রতি মাসে তার নামের চাল কে বা কারা তুলে নিচ্ছে। অথচ অভাবের তাড়নায় দুই ছেলে অসিম ও নয়নকে নিয়ে অশোক দত্ত ঢাকায় চলে গেছেন। লেখাপড়া ছেড়ে তার দুই ছেলে এখন গার্মেন্টস কর্মী।
মুঠোফোন কথা বলতে গিয়ে আশোক ও তার স্ত্রী শিখা রানী দত্ত কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা বলেন, চরম অভাবের তাড়নায় দুমুঠো ভাতের জন্য আমরা গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছি। অথচ আমাদের নামে কে বা কারা চাল তুলে খাচ্ছে আমরা নিজেরাও জানি না।
অশোক দত্ত জানান, ২ থেকে ৩ বছর আগে প্রতিবেশি চিত্ত দত্তের ছেলে বিপুল তার চালের কার্ড করে দিবেন বলে ছবি নেন। তার নামে কার্ড হলেও তিনি প্রতি মাসে ৩০ কেজি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল পাচ্ছেন না।
জানা গেছে, অশোকের জাতীয় পরিচয়পত্র (৪৪১১৯৫২১৯২৯৩৪) ব্যাবহার করে তার ছোট ভাই তপন দত্ত ও বোন জোছনা রানীসহ চোরকোল গ্রামের আকবর আলীর ছেলে রমজান আলী, একই গ্রামের এজের আলীর ছেলে দশর আলী এবং মামুনশিয়া গ্রামের ইউসুফের ছেলে তক্কেল ও একই গ্রামের ইসরাফিলের স্ত্রী আকলিমার ১০ টাকা কেজি দরের চালের কার্ড হয়েছে।
এছাড়াও গোপালপুর গ্রামের মোজাম্মেল হকের স্ত্রী ফাতেমা বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্র (৪৪১১৯৫২১৯১৯২২) ব্যবহার করে ওয়াড়িয়া গ্রামের এজের আলীর ছেলে তাইজেল, চোরকোল গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে বিপুল, আকবর আলীর ছেলে বরকত আলী, পানি মুন্সির ছেলে আরজানের কার্ড হয়েছে।
মধুহাটী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফারুক আহম্মেদ জুয়েল বলেন, তড়িঘড়ি করে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল আমি নির্বাচিত হওয়ার ১৫ দিন পর। তাই তালিকা করতে গিয়ে কিছুটা ভুলত্রুটি হয়েছে। এখন বাদ দিয়ে সঠিক তালিকা জমা দেয়া হয়েছে।
অভিযোগে বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসনাত বলেন, এ ঘটনায় আমি তদন্তে গিয়েছিলাম। তবে এখনই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।
এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ঝিনাইদহ সদরের কৃষি কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম বলেন, আমি সবেমাত্র তদন্ত শুরু করেছি। দুটি গ্রামে গিয়ে কিছুটা সত্যতাও পাওয়া গেছে। এখন গোটা ইউনিয়ন ঘুরে দেখে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিব।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মধুহাটী ইউনিয়নের বাসিন্দা আশরাফুল আলম বলেন, অভিযোগকারীরা বিষয়টি আমাকে জানিয়েছে। আমি তদন্ত করে দেখেছি চালের কার্ড করার প্রক্রিয়াটি খবুই অসচ্ছ, দুর্নীতি হয়েছে।
তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা তো অভিযোগ করেছেন। এখন বিষয়টি যথাযথভাবে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। আমি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও প্রশাসনকে বলেছি। তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে অভিযোগকারীদের আশ্বস্ত করেছেন।