সাইবার হামলার হুমকির মুখে পাকিস্তান
গোপন নজরদারির জন্য ২০১৯ সালে পাকিস্তানের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তার মোবাইল ফোন হ্যাক করা হয়েছিল। পেগাসাস (ইসরাইলের স্পাইওয়্যার কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরী) নামে অভিহিত বিশেষ ধরনের ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে হ্যাকিং করা হয়েছিল। ম্যালওয়্যারটি টার্গেট করা হোয়াটঅ্যাপ নম্বরে মিস কল দিয়ে ম্যালওয়্যার ফোনে ঢুকে গিয়ে ফোনের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনটি চালু করতে পারে, সেইসাথে মেসেজ, ইমেইল, কন্টাক্ট ও পাসওয়ার্ডে প্রবেশ করতে পারে। ম্যালওয়্যারটির জিপিএস লোকেশনও নির্ধারণ করার সক্ষমতা ছিল। এই হ্যাকিংয়ের পর পাকিস্তান সরকার স্পর্শকাতর ও গোপনীয় তথ্য সুরক্ষার জন্য বিকল্প কিছু উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের কে টার্গেট করেছিল, তা এখনো অজানা রয়ে গেছে। অবশ্য ওই প্রতিবেদনের পর জানা গেছে যে ভারতীয় আইনজীবী, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের ওপর নজরদারি চালানোর জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একই ইসরাইলি স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত তাদের রক্ষণাত্মক ও আক্রমণাত্মক সাইবার ওয়্যারফেয়ার সক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরিতার কারণে উভয় দেশই একে অপরের সাইবার হামলার টার্গেট হতে পারে। এখন পর্যন্ত যদিও ভারত বা পাকিস্তান কেউই একে অপরের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সাইবার হামলা চালায়নি, কিন্তু দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ছোট আকারের সাইবার হামলা প্রায়ই হয়ে থাকে। বিশেষ করে, ওয়েব হ্যাকিং প্রায়ই হয়ে থাকে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সাইবার হামলার হুমকি আরো গুরুতর রূপ ধারণ করেছে ইসরাইলের সাথে ভারতের ক্রমবর্ধমান সাইবার সিকিউরিটি সহযোগিতার কারণে। ইসরাইল হলো সাইবার সিকিউরিটি গবেষণা ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। ২০১৯ সালের জুনে ইসরইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু (বার্ষিক আন্তর্জাতিক সাইবার সিকিউরিটি সম্মেলনে বক্তৃতাকালে) বলেন, ইসরাইল বিশ্বে শীর্ষ ৫ সাইবার সিকিউরিটি শক্তির একটি হবে, এই লক্ষ্য আমি নির্ধারণ করেছি। … আমরা এই লক্ষ্য পূরণ করব।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ইসরাইল অনেক বেশি বিনিয়োগ করে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা এখন ইসরাইলের ট্যালপিয়ট প্রশিক্ষণ কর্মসূচির দিকে নজর দিয়েছেন। বিশ্বে এ ধরনের কর্মসূচি এটিই প্রথম। এই কর্মসূচির আওতায় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশের সবচেয়ে প্রতিভাধর ও উদ্ভাবনমুখী তরুণদের নিয়োগ করে তাদেরকে অত্যাধুনিক পদার্থবিদ্যা, গণিত ও কম্পিউটার সায়েন্স প্রশিক্ষণ দেয়। এর ফলে এমনসব বিশেষজ্ঞ তৈরী হচ্ছে, যা ইসরাইলের সামরিক গবেষণা ও সাইবার সিকিউরিটিকে জোরদার করছে।
সাবেক সিআইএ ঠিকাদার অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন ২০১৩ সালের মার্চে ফাঁস করে দেন যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসএর নজরদারির সবচেয়ে বড় টার্গেটগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান। ২০১৭ সালের জুনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানায়, সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান টার্গেট হলো পাকিস্তান। পাকিস্তান বিদেশী গোয়েন্দাদের শীর্ষ টার্গেট হওয়ায় কম্পিউটার সিস্টেম নিশ্চিত করার জন্য গবেষণা, ডিজিটাল অবকাঠামো খাতসহ এ দিকে আরো বেশি সম্পদ বিনিয়োগ প্রয়োজন।
পাকিস্তান সরকারের প্রয়োজন হবে সাইবার হুমকি সামাল দেয়ার জন্য এর সংস্থাগুলোকে দক্ষ করে গড়ে তোলা। বর্তমানে দেশের সাইবার সিকিউরিটির ব্যাপারে পুরো দায়দায়িত্ব থাকা কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নেই। সাইবার হামলা থেকে দেশকে সুরক্ষার জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ সংস্থা।
সাইবার হুমকি প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তানের পর্যাপ্ত আইনেরও অভাব রয়েছে। ২০১৬ সালে পাকিস্তান প্রিভেনশন অব ইলেকট্রনিক ক্রাইমস অ্যাক্ট, ২০১৬ নামের একটি সাইবার অপরাধ আইন প্রণয়ন করলেও তা সাইবার নিরাপত্তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। পাকিস্তানের প্রয়োজন আরো কঠিন আইন ও ব্যবস্থা।
পাকিস্তানের বোঝা উচিত যে তার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে এবং দেশের পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অবকাঠামোগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। এ কারণে পাকিস্তানের জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত জাতীয় অবকাঠামোগুলো শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। সংক্ষেপে বলা যায়, পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে আসন্ন ও ভবিষ্যতের সাইবার হুমকিগুলো চিহ্নিত করা ও সে অনুযায়ী সাইবার কৌশল প্রণয়ন করা। পাকিস্তান এসব হুমকি কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনা করা ছাড়া ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না।