চীনের সাথে বিরোধ নিয়ে ভারতের সিনিয়র জেনারেল, লেফটেন্যান্ট-জেনারেলদের মধ্যে অসন্তোষ!

0

গত ২ জুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতের ‘নিউজ১৮’ টিভিকেই এক একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়ে বসেন। কেন নিউজ১৮ টিভি? ব্যাপারটাকে আমরা এভাবে পাঠ করতে পারি যে, ওই সাক্ষাৎকারটার মানে হলো, ইতোমধ্যে চীন-ভারত সীমান্ত টেনশন ইস্যুতে ভারত-আমেরিকান কূটনৈতিক আলোচনা ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়ে গেছে। সেখানে পরস্পরের অসুবিধা আর প্রয়োজনগুলো নিয়ে জানা-জানানো ও পরস্পরের পছন্দ হয় এমন অবস্থানও সাব্যস্ত হয়ে গেছে। এখন ওই আলোচনায় কী সাব্যস্ত হয়েছে মোদি সরকার কী মেনেছেন এর পরোক্ষ অফিসিয়াল স্বীকৃতি বা রেকর্ড তৈরি করে রাখতেই ওই সাক্ষাৎকার দেয়া। কিন্তু তাহলে সেটা কেবল নিউজ১৮ টিভিকে দেয়া কেন? কারণ নিউজ১৮ আর সিএনএন কোনো কোনো প্রোগ্রাম জয়েন্ট ভেঞ্চারে সম্পর্কে চলে। অর্থাৎ সিএনএনের ভারতে কোনো স্বার্থ থাকলে সেটা নিউজ১৮-ই দেখাশুনা করে থাকে। এই অর্থে রাজনাথের ওই সাক্ষাৎকারটা দেয়া হয়েছে পরোক্ষে আমেরিকান সিএনএনকে। যেখান থেকে যেন ট্রাম্প প্রশাসন অফিসিয়াল ভার্সন সংগ্রহ করে নিতে পারে। অর্থাৎ এটা একটা সাক্ষাৎকারের পাবলিক ভার্সনই কিন্তু সেই ভার্সনটাই আবার ট্রাম্প প্রশাসনের সংগৃহীত অফিসিয়াল ভার্সন।

ওই সাক্ষাৎকারে রাজনাথ মূল যে কথাটা বলেন তা হলো, দু’পক্ষের সিনিয়র মিলিটারি অফিসারেরা বৈঠকে বসে ‘মতপার্থক্য’ দূর করে ফেলবে। বেশির ভাগ পত্রিকার শিরোনাম কথিত এই মতপার্থক্য নিয়েই। কিন্তু ‘কী নিয়ে’ মতপার্থক্য যার জন্য তিন ডিভিশন করে সেনাসামন্তের সমাবেশ ঘটাতে হলো? মিডিয়া লিখেছে ‘সীমান্ত বিতর্ক’ বা বর্ডার ডিস্পুট নিয়ে মতপার্থক্য। যারা রাজনাথকে সরাসরি উদ্ধৃত করেছে তাদের লেখায় রাজনাথ কিভাবে সীমান্ত উত্তেজনাকে মোলায়েম করে কথা বলেছেন তা লক্ষণীয়। প্রথমত, তিনি এটিকে সীমানা বিষয়ে দু’দেশের দু’রকম ধারণাজাত একেবারেই এক তুচ্ছ সমস্যা বলে দাবি ও চিহ্নিত করে সব উত্তেজনায় ক্রমাগত পানি ঢেলে গেছেন।

বলেছেন, এলএসি (LAC) বা ‘দু’দেশের দখলে থাকা ভূমির সীমানা নিয়ে আমাদের দু’দেশের যে পারসেপশন; এই পারসেপশনে ভিন্নতার কারণে আমাদের মতপার্থ্যক্য। আরো মোলায়েম ভাষ্য এরপরেও আছে। রাজনাথ বলছেন, ‘এতে চীনারা বেশ ভালো সংখ্যায় (গুড নাম্বার) সৈন্য সমাবেশ করেছিল। আর ভারতও তাতে ‘প্রয়োজনীয় সংখ্যক’ (হোয়াট-এভার ইজ রিকোয়ার্ড) সৈন্য জমায়েত করেছিল।’ কেন তিনি এত মোলায়েম ভাষায় কথা বলছেন সেই সাফাই গাইতে গিয়ে বলছেন, ‘এমনকি আগেও যখনই সীমানা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে যেমন ওই ডোকলামে (ভুটানে চীনা সীমান্ত নিয়ে) তখনো আমরা সামরিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে কথা বলেই মতপার্থক্য মিটিয়ে ফেলেছিলাম।’ সারকথায় এখানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং কেবল বলতে বাকি রেখেছেন কিন্তু যেন বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ‘আমরা দুই রাষ্ট্র আসলে খুব ভালো। আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। ট্রাম্প-মোদির যে ব্যক্তি লাভালাভ এ থেকে তুলে আনার কথা ছিল তা এখন উঠে গেছে। তাই আপনারা আর খামোখা চিন্তা করবেন না।’

কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। ভারতের মিডিয়াগুলো ক্রমশ অসন্তোষে ভরে উঠতে শুরু করেছে। আর তা ভরে তুলতে শুরু করেছে মূলত অবসরে যাওয়া সিনিয়র জেনারেল, লেফটেন্যান্ট-জেনারেলদের অসন্তোষ। তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন প্রকাশ্যেই তাদের অসন্তোষ, আপত্তি ও সরকারি ব্যাখ্যায় গরমিল নিয়ে প্রশ্ন আর সর্বোপরি চীন আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি ভূখণ্ড দখল করে ফেলেছে- এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এ দু’জন ব্যক্তিত্ব হলেন- এক সাবেক উত্তরের আর্মি কমান্ডার লে. জে ডিএস হুডা (রিটায়ার্ড)। আর অপরজন হলেন লে. জে এইচএস পানাগ (রিটায়ার্ড)।
লে. জে পানাগ ক্ষুব্ধভাবে লিখছেন, ‘অফিসিয়ালি দু’পক্ষই বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা ও কূটনীতিক আলোচনায় বিবাদ মিটানোর ওপর আস্থা প্রকাশ করেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কূটনীতিক ও মিলিটারি পর্যায়ে আলাপ আগাচ্ছে। কেবল এলএসি’র ‘পারসেপশনে মতপার্থক্য’ শব্দটাকে কুপিয়েছেন। আবার ‘আচ্ছা সংখ্যক’ চীনা সৈন্যের উপস্থিতির কথাও বলেছেন। ইতোমধ্যেই মেজর জেলারেল পর্যায়ে ২ জুনই আলোচনা হয়ে গেছে। এখন ৬ জুন অসমাপ্ত আলোচনা আবার হবে। তবে এবার তা হবে লে. জে. অফিসার পর্যায়ে। আর এতেই তিনি অসন্তুষ্ট।

এ ছাড়া আরেক লে. জে-এর বক্তব্য হলো, গত জুনের শুরুতে চীনারা বিভিন্ন জায়গায় ৪০-৬০ বর্গকিমির মতো এলাকা যা আগে ভারতের দখলে ছিল তা দখল করে নিয়ে গেছে। ফলে এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে এখন আলোচনার টেবিলে তারা কথা বলবে আপারহ্যান্ডে থেকে, গলা চড়িয়ে। ফলে হারানো ভূমি ফেরত পাওয়া ভারতের জন্য মুশকিল হবে। এটাই এই লে. জে-এর বিরাট আপত্তির জায়গা।

কারণ এখন আলোচনা যদি একেবারে ফেল করে যায় তবে চীন প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে বলে সীমিত যুদ্ধ লাগিয়ে এখন সব দখল করে সেসব দখল স্থায়ী করে ফেলতে পারে। এ কারণে এবার মোদির বিরুদ্ধে তিনি নামধরে সরাসরি অভিযোগ এনে বলছেন, এই পরিস্থিতিতে ‘মোদি সরকার ও তার সামরিক বাহিনী এই সব অভিযোগ (ভূমি হারানোর অভিযোগ) ‘অস্বীকার’ (ডিনায়েল) করে আর ‘সীমান্ত পারসেপশনের ভিন্নতা’ বলে পার পেতে চাইছে। তিনি আরো অভিযোগ এনেছেন যে, কিছু সাংবাদিককে সরকার নামিয়েছে ‘সীমান্ত পারসেপশনের ভিন্নতা’ বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। তার সারকথা ভারত এখন চীনাদের হাতে নাচা পুতুল হয়ে যাবে। এমনকি ওই লেখাটা তিনি নিজের নামে দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় লিখেছেন, যার শিরোনামে আরো ভরপুর ক্ষোভ ও উসকানিমূলক শব্দ আছে। ভারত যে ভূমি হারিয়েছে বলে তিনি দাবি করছেন, তার স্যাটেলাইট ম্যাপের ছবি জোগাড় করে তা পত্রিকায় ছাপিয়ে দাবি করে লিখেছেন যে, ওই হারানো ভূমির ছবি দেখতে হাতের আঙুলের মতোন। তাই নিজের লেখার শিরোনাম দিয়েছেন, “ভারতের আঙুল চীনের বুটের নিচে চাপা পড়েছে, ‘অস্বীকার’ করে লাভ হবে না।”

ওই একই দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় স্নেহেশ এলেক্স ফিলিপ নামে আরেকজন রিপোর্টার বিভিন্ন সেনা কমান্ডারের মতামত সংগ্রহ করে আরেক রিপোর্ট লিখেছেন প্রায় একই ধরনের সব অভিযোগে। তিনি ওই নজিরবহীন শব্দটা ব্যবহার করে বলছেন, এই শব্দটা জেনারেলদের বেশির ভাগই ব্যবহার করে তার সাথে কথা বলেছেন। তাদের দাবি চীন-ভারত সীমান্তবিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের চুক্তিতে দু’দেশের সেনাদের মধ্যে ডায়লগের যেসব প্রটোকল সাব্যস্ত হয়ে আছে সে অনুযায়ী লে. জে পর্যায়ের অফিসারেরা বৈঠকে বসলে সেটি প্রতিষ্ঠিত প্রটোকল ভঙ্গ করা হবে। কারণ প্রটোকলে লোকাল ট্যাকটিক্যাল কমান্ডার (পদবি মে. জে মর্যাদার) লেভেলে ডায়লগের করার কথা বলা হয়েছে। ফলে এখন ভারতের ১৪ কোর কমান্ডারকে চীনের মেলিটারি ডিস্ট্রিক কমান্ডারের সাথে বসতে হবে। এ জন্য তারা এটাকে নজিরবিহীন বলছেন। এই প্রসঙ্গে আরেকজন লে. জে ডিএস হুডা (রিটায়ার্ড) গত দিন এক অনলাইন সেমিনারে মন্তব্য করেছেন, তিনিও এমনটা জীবনে কখনো দেখেননি। স্নেনেশ লিখেছে। এই প্রটোকল মানা না মানা নিয়ে গত দিনের অনলাইন সেমিনারে অন্য রিটায়ার্ড অফিসারদের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে আমাদের ব্যাখ্যা ও অনুমান সঠিক যে মোদি-ট্রাম্প তাদের ব্যক্তিগত লাভালাভের স্বার্থ মিটাতে সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটানোর পক্ষে উসকানি তৈরি করেছে। কিন্তু এখন ঘটনাচক্রে লাভের পাল্লা চীনের দিকে চলে যাওয়া এই হাতছুট ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সামরিক অফিসার আর সাংবাদিকদের পর্যায়ে প্রবল হারু-পার্টি হয়ে যাওয়ার হাহাকার উঠে আসছে। আর মোদির পক্ষের লোকেরা ততই ডিনাইয়াল মানে অস্বীকার করে ফসল ঘরে তুলতে চাইছে- বিরোধ বেধেছে এখানেই। লক্ষণীয় যে, কোনো সিভিল কূটনীতিক লোক মোদি-রাজনাথের এখনকার পরিকল্পিত আলাপের কোনো পর্যায়ে যুক্ত থাকছেন না। মানে হারানো ভূমি উদ্ধারের দায় এখন পুরাটাই সামরিক অফিসারদের ওপর। আর ভূমি উদ্ধার না হলে বা সীমিত যুদ্ধে তা স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেললে সে দায়ও হবে সামরিক অফিসারদের। এখন মোদি ব্যক্তিগত লাভালাভ তার ঘরে তুলে নেয়ার বিনিময়ে ভারত রাষ্ট্রকে এর কাফফারা দিতে হতে যাচ্ছে, খুব সম্ভবত। এটাই উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি করছে।
শেষ পর্যন্ত কী ঘটে সেটি দেখতে আর দু’দিন অপেক্ষা করতে হবে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com