৭০০ টাকার বিদ্যুৎ বিল এক লাফে ৩৮০০
কোথাও বন্ধ দোকানে তিনগুণ বিদ্যুৎ বিল, কোথাও মিটার না দেখেই বিলের কাগজে ইচ্ছামতো বসানো হয়েছে ইউনিট। করোনাভাইরাসের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে এভাবেই চলছে বগুড়ার বিদ্যুৎ বিভাগ।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকলেও গ্রাহকদের একটি অংশ বিদ্যুৎ বিল নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে। কয়েক মাস ধরে বগুড়া জেলা শহর ও উপজেলাগুলোতে বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল আসায় (আগের কয়েক মাসের বিলের ধারাবাহিকতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি) মানুষ ক্ষুব্ধ।
ভুতুড়ে বিলের প্রতিবাদে কেউ কেউ বিক্ষোভ করছেন। কেউ কেউ আবার অফিসে অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিলে ঢুকেছে সিন্দাবাদের ভূত। দেশে চলমান অস্থিরতায় ‘অদ্ভুত’ বিদ্যুৎ বিলের ফাঁদে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন শত শত বিদ্যুৎ গ্রাহক।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, গ্রাহকদের পুরাতন বিদ্যুৎ মিটার পরিবর্তনে বাধ্য করতে বিদ্যুৎ বিভাগের নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) আওতাধীন বগুড়ার বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগগুলো থেকে এমন ভুতুড়ে বিল দেয়া হয়েছে। অথচ আগের মিটারগুলোতে কোনো সমস্যাই নেই।
মিটারে ব্যবহৃত ইউনিট যাই হোক না কেন; খেয়াল-খুশি মতো বিল করে ডিজিটাল মিটার স্থাপনের জন্য আবার অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় গ্রাহকরা। নিয়ম না থাকলেও এই বিলের নাম দেয়া হয়েছে ‘এস্টিমেটেড’ ইউনিট বিল। এখানে ইচ্ছামতো বসানো ইউনিটের বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে গ্রাহকদের।
জানা গেছে, বগুড়া শহরের সূত্রাপুর এলাকার একটি সড়কে পাশাপাশি বসবাস করে কয়েকটি পরিবার। তারা নেসকোর বিতরণ বিভাগ-২ এর গ্রাহক। চলতি মাসে তাদের অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল এসেছে।
এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত মাসগুলোতে আমার বিদ্যুৎ বিল ৭০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে আসতো। কিন্তু গত এপ্রিল ও মে মাসে হঠাৎ বিল আসে তিন হাজার ৮০০ টাকা করে। আমি যেসব বৈদ্যুতিক জিনিস আগে ব্যবহার করতাম এখনও সেসব জিনিসই ব্যবহার করছি। তাহলে হঠাৎ কেন এক লাফে ৭০০ টাকার বিদ্যুৎ বিল ৩৮০০ টাকা আসবে?
রেজাউল হাসান শহরের নিশিন্দারা এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, বিগত মাসগুলোতে গড়ে দুই হাজার থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে বিদ্যুৎ বিল আসতো। এপ্রিল মাসে সেই বিল এসেছে সাত হাজার ১৬১ টাকা। আমার মিটারের যে ইউনিট দেখানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সেই ইউনিট নেই। অর্থাৎ মিটার না দেখেই এতো টাকা বিল করা হয়েছে।
একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা একই ধরনের অভিযোগ করে বলেন, আমার বাসার অতিরিক্ত বিল নিয়ে আমি কথা বলি নেসকো বগুড়া বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শিহাব উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি এ বিষয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে উল্টো আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। তিনি এটাও বলেন, এই বিল দিতেই হবে।
তবে নির্বাহী প্রকৌশলী শিহাব উদ্দিন এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বিদ্যুৎ বিল নিয়ে আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর মিটারের সমস্যা দেখলেই আমরা এস্টিমেটেড বিল করি।
আরেক গ্রাহক বলেন, ২৩ মার্চে আমার মিটারের রিডিং ১০৪৮৯ এবং পূর্ববর্তী রিডিং ছিল ৯৮৪০, যার ব্যবহৃত ইউনিট লেখা হয়েছে ৭৭০। কিন্তু ওই বিলের বর্তমান ও পূর্ববর্তী রিডিংয়ের প্রকৃত ফল হবে ৬৪০। অর্থাৎ ১৩০ ইউনিট বেশি লেখা হয়েছে। একইভাবে পরবর্তী মাসেও গড়ে থেকে ২০০ ইউনিট করে বেশি বিল লেখা হয়েছে। এ ব্যাপারে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাইনি।
ফৌজিয়া রহমান নামের একজন জানান, তার বাসায় মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তিনি শুধু একটা ফ্রিজ আর তিনটা ফ্যান ও কয়েকটি লাইট ব্যবহার করেন। গত দুই মাস হলো সেই বিল বেড়ে গিয়ে সাড়ে তিন হাজারে দাঁড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া শহর এলাকায় বিদ্যুৎ বিভাগের নেসকোর আওতায় তিনটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ রয়েছে। এর গ্রাহক সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজারের ওপরে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সরকারি নির্দেশনায় এনালগ মিটারগুলো ডিজিটাল করা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। যারা মিটার পরিবর্তন করছেন না, তাদের এস্টিমেটেড বিল করা হচ্ছে। কিন্তু নির্দেশনা মতো যাদের মিটার খারাপ হয়েছে; শুধু তারাই নতুন ডিজিটাল মিটার নিতে বাধ্য।
বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে আগের মাসগুলোর বিলের পরিমাণের সঙ্গে গড় করে কিছু বাড়তি ইউনিট যোগ করে গ্রাহকদের কাছে বিল দেয়া হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে গ্রাহকদের ওপর মিটার পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে। এই বাড়তি বিলে নিয়ে গ্রাহকদের হয়রানির বেড়েই চলছে।
বগুড়ার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগগুলো জানায়, তাদের মোট সংযোগের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ এনালগ মিটার ডিজিটাল মিটারে পরিণত করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী মিটার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের শুধুমাত্র মিটার কিনে দিলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিতরণ ও বিক্রয় বিভাগ থেকে তা কোনো ফি ছাড়াই স্থাপন করে দেয়ার কথা। তবে এক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। মিটার পরিবর্তনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক শ্রেণির দালাল। তারা মিটার রিডারদের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিদ্যুৎ বিভাগের বাড়তি বিলের কপি গ্রাহকদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলছে, মিটার পরিবর্তন না করা পর্যন্ত বাড়তি বিলের (এস্টিমেটেড) পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এতে কোনো লাভ হচ্ছে না। মিটারের দামসহ একটি মিটার স্থাপনের জন্য নেয়া হচ্ছে দুই হাজার টাকা। অথচ বাজারে একটি ডিজিটাল মিটারের দাম এক হাজার ১২০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা। এক্ষেত্রে মিটার পরিবর্তনের জন্য গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ৮০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকার ভাগ আবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
আবার মিটার পরিবর্তনের জন্য যে এস্টিমেটেড বিল করা হয় তা সমন্বয়ের জন্য হয়রানি ও বাড়তি খরচ দিতে হয় গ্রাহকদের।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মিটার রিডার ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিদ্যুৎ বিল পৌঁছে দেয়ার কথা থাকলেও সেটি সংশ্লিষ্টরা ভাড়াটে বা ব্যক্তিগতভাবে নিয়োগ করা লোকদের মাধ্যমে মিটার রিডিং ও বিল বিতরণ করে।