চরম নিষ্ঠুরতা, ত্রাণ পেতে ভিক্ষার চাল বিক্রি করে মেম্বারকে ঘুষ
চাল নেই, চুলা নেই, নেই বসতঘর। স্বামী নেই, সন্তান নেই, নেই সহায়-সম্বল। ঠিক এতটা অসহায় একজন মানুষ কোহিনুর বেগম (৬২)। বরগুনা সদর উপজেলার বালিয়াতলী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের চালিতাতলী এলাকার বাসিন্দা তিনি।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ। রোগে শোকে হারিয়েছেন শারীরিক সক্ষমতা। দু’চোখে ঠিকমতো দেখেন না। ভিক্ষাবৃত্তি করেই চলছিল জীবনের শেষ দিনগুলো। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে থেমে গেছে তার জীবন-জীবিকা। করোনার সংক্রমণ রোধে অপরিচিত এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে আসতে দিচ্ছেন না কেউ। তাই ভিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে গেছে কোহিনুর বেগমের।
একদিকে রমজান মাস; তার ওপর প্রচণ্ড দাবদাহ। কোনোভাবেই জ্বলছিল না ঘরের চুলা, দমছিল না পেটের ক্ষুধা। নিরুপায় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা পেতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শামীম গাজীর কাছে ছুটে যান বৃদ্ধা কোহিনুর বেগম। প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা পাইয়ে দিতে বৃদ্ধার ভিক্ষা করে পাওয়া চাল বিক্রি করে দুই হাজার টাকা নিয়েছেন ইউপি সদস্য (মেম্বার) শামীম গাজী।
পরে বিষয়টি জানাজানি হয়। নির্মম ঘটনাটি শুনে সোমবার সন্ধ্যায় বৃদ্ধার কাছে ছুটে যান বরগুনা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান হোসেন। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে বৃদ্ধার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নেয়ার সত্যতা পান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে আরও কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির কাছ থেকে ইউপি সদস্য শামীম গাজী ও তার বাবা কাদের গাজী ঘুষ নিয়েছেন বলে জানতে পারেন তিনি।
বরগুনা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, নির্মম ঘটনাটি শুনে সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান হোসেন সোমবার সন্ধ্যায় বৃদ্ধা কোহিনুর বেগমের বাড়িতে যান। এরপর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বৃদ্ধা কোহিনুর বেগমকে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা পাইয়ে দিতে শামীমের ঘুষগ্রহণের অভিযোগের সত্যতা পান। এ ঘটনা তিনি তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে বসেই বরগুনা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে অবহিত করেন।
ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা দিতে শুধু শামীম গাজী একার বিরুদ্ধে ঘুষগ্রহণের অভিযোগ নয়; এরকম অনেক অভিযোগ এসেছে তার বাবা আ. কাদের গাজীর বিরুদ্ধেও। এ বিষয়ে আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ওই এলাকার একাধিক দরিদ্র অসহায় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু কহিনুর বেগম নন; একই এলাকার আরও অনেক অসহায় মানুষের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন ইউপি সদস্য শামীম গাজী ও তার বাবা কাদের গাজী।
ওই গ্রামের শ্রমিক আব্দুস সালাম, দিনমজুর বশির আকন, হেলাল মিয়া এবং সেলিনাসহ একাধিক ভুক্তভোগী স্থানীয় ইউপি সদস্য শামীম গাজী ও তার বাবা কাদের গাজীকে ঘুষ দেয়ার কথা জানিয়েছেন।
পরে ইউপি সদস্য শামীম গাজী ও তার বাবা কাদের গাজীর বিরুদ্ধে একই এলাকার আব্দুস সালাম নামে একজন ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। ওই অভিযোগে তিনি আরও অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন; প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন ইউপি সদস্য ও তার বাবা কাদের গাজী।
এদিকে, নিষ্ঠুর নির্মমতার শিকার বৃদ্ধা কোহিনুর বেগমের পাশে দাঁড়িয়েছেন বরগুনা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান হোসেন। আগামী এক মাসের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বৃদ্ধার হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি। এছাড়া বৃদ্ধাকে সরকারি সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দিতে বলেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
বরগুনা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান হোসেন বলেন, শামীম গাজী ওই বৃদ্ধার সঙ্গে যা করেছেন, এই সঙ্কটকালীন এর থেকে নিষ্ঠুর নির্মমতা আর কিছু হতে পারে না। শুধু শামীম গাজী নন; প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা পাইয়ে দেয়ার আশ্বাসে দরিদ্রদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন তার বাবাও। তাই তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ওই বৃদ্ধাকে আইনগত সহযোগিতার পাশাপাশি ইতোমধ্যে মানবিক সহায়তা দিয়েছি।
বরগুনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ইউপি সদস্য শামীম গাজী ও তার বাবা কাদের গাজীর বিরুদ্ধে ঘুষগ্রহণের ঘটনা জেনেছি। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছি; কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।