আগে জিলাপি পরে জীবন
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সবাই যেভাবে লকডাউন ভেঙ্গে বের হয়ে যাচ্ছি, তাতে সরকারের সেই পুরোনো ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ নীতির প্রতিফলই দেখা যাচ্ছে। সবাই যেন আজ প্রচন্ড অস্থির! ধৈর্যচ্যুত! ‘জীবন ও জীবিকার লড়াইয়ে’ জীবনকেই যেন পেছনে ফেলে হাঁটছি। ভাবছি, জীবন জীবিকার এ লড়াইয়ে জীবন যাবে তো গরীবের; তাই বলে কি উন্নয়নের চাকা থামানো ঠিক হবে! নাহলে, কি করে আমরা দলবল নিয়ে কৃষকের মাঠে কাঁচা ধান কাটার ফটোসেশন করতে পারি? কি করে আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই শত শত গার্মেন্টস খুলে দিয়ে, করোনার ঝুঁকি নিয়ে চাকরি বাঁচাতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজে আসতে বাধ্য করতে পারি? কি করে আমরা সামান্য জিলাপি খাওয়ার লোভ সংবরণ করতে না পেরে ইফতারির বাজার খুলে দিতে পারি? এতো দেখছি, ‘আগে উন্নয়ন পরে জীবন নীতি’কেও হার মানিয়ে ‘আগে জিলাপি পরে জীবন’ নীতিকেই বেশী পছন্দ করছি!
পৃথিবীর খোঁজখবর কি রাখছি আমরা? বিশ্বে প্রথম ৯০ দিনে মারা গেছে এক লাখ মানুষ। কিন্তু পরের মাত্র ১৫ দিনেই মারা গেছে আরও এক লাখ মানুষ। আমাদের দেশেও এখন আক্রান্ত ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। করোনায় মরছে ডাক্তার। মরছে সাংবাদিক। মরছে পুলিশ। গার্মেন্টস শ্রমিকও করোনায় আক্রান্ত।
ইতালি, স্পেন, আমেরিকা ধৈর্য হারা হয়ে ভয়াবহ ক্ষতির মাসুল গুণছে। যুক্তরাজ্য ৬৭তম দিনে, ফ্রান্স ৬৬, জার্মানি ও স্পেনে ৬১, ইতালি ৫৩, ইরানে ৪২, এবং নেদারল্যান্ডসে ৩৮ তম দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত শনাক্ত হয়। বাংলাদেশের আক্রান্তের সব ধরনের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে ধারণা করা যেতে পারে যে, মে মাসে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। সরকারও কিন্তু সেইরকমই পরিসংখ্যানই দিয়েছে।গত ২১ এপ্রিল সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা দুটি সিনারিও প্রস্তুত করেছেন। প্রথমটি বলছে, ৩১ মে পর্যন্ত ৪৮ থেকে ৫০ হাজার ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। দ্বিতীয় প্রক্ষেপণ অনুযায়ী আক্রান্ত হতে পারে প্রায় এক লাখ মানুষ।
অথচ গার্মেন্টস মালিকরা অস্থির হয়ে গিয়েছে। বলছে, তাদের অর্ডার বাতিল হয়েছে ৩ বিলিয়ন ডলারের। অথচ বছরে মোট পোশাক রপ্তানি হয় ৩৪ বিলিয়ন ডলারের। তারমানে ৯০% অর্ডার এখনও বহাল আছে। যা থেকে নিশ্চিতভাবে মুনাফা থাকবে। সাথে শ্রমিকদের বেতন বাবদ সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মালিকরা কি এতটাই নিঃস্ব সর্বশান্ত হয়ে গেলেন যে, শ্রমিকের বেতনের জন্য তাদের কাছে কোন টাকাই নাই? তাহলে শ্রমিকদের বেতন বাবদ সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ কার জন্য দিলো? গণহারে গার্মেন্টস কারখানাগুলো লেঅফ করে শ্রমিক ছাটাই করা হচ্ছে। অথচ সরকার মুখে বলছে, লেঅফ বা শ্রমিক ছাটাই করা যাবে না। কিন্তু গণমাধ্যমে ছবিটা অন্যরকমের। চাকরি হারিয়ে, বেতন না পেয়ে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার দাবীতে শ্রমিকরা আন্দোলন-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি আগেই বলেছিলাম, মিথ্যা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের জীবন নিয়ে খেলা হচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের চাকরি রক্ষার্থে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করা হোক। বলেছিলাম, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ১২, ১৬, ১৭ এবং ১৮ এর বিধানাবলীতে যা বর্ণিত থাকুক না কেন।রাষ্ট্রপতির এই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে পরবর্তী ৯০ দিন পর্যন্ত দেশের সকল গার্মেন্ট শ্রমিককে সবধরনের লে অফ করা এবং তাদেরকে সবধরনের ছাঁটাই করে দেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে অবিলম্বে এই অধ্যাদেশ জারী ও বলবৎ করা হোক। এটা করা হলে আজ হয়ত শ্রমিকের ভাগ্যের সাথে এরকমভাবে ‘চোর-পুলিশ খেলা’ দেখতে হতো না!
গত ১৮ মার্চ হাইকোর্টের এক আদেশের ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ১৯ মার্চ করোনা ভাইরাসকে সংক্রামক ব্যধির তালিকাভুক্ত করে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর ৫ ধারার অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
সংক্রামক রোগ ২০১৮ সালের আইন মোতাবেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তৃক জারিকৃত ১৬ এপ্রিলের নির্দেশ অনুসারে “অতিব জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবেনা”। এ আইন মোতাবেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তৃক জারিকৃত এই নির্দেশ অমান্য করা একটি ফৌজদারী অপরাধ। প্রশ্ন হচ্ছে, অধিদপ্তর কি এসব দায়িত্ব পালন করছে?
সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, যে সকল কর্তৃপক্ষ “অতিব জরুরি প্রয়োজন” নয় এমন সব কাজের (কৃষকের কাঁচা ধান কেটে ফটোসেশন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গার্মেন্টস খুলে দেয়া, করোনার ঝুঁকি নিয়ে চাকরি বাঁচাতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজে আসতে বাধ্য করা, জিলাপির দোকান খোলা, ইত্যাদি) অনুমোদন দিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে কি সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এ ফৌজদারি অপরাধের অধীনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে? নাকি সরকারের ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ নীতির মতই ‘আগে উন্নয়ন পরে জীবন’ নীতির বিজয় হবে?
ডক্টর তুহিন মালিক
আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ