১১ দিনেও শেষ হয় না টেস্ট
১৮ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন আইইডিসিআরের হটলাইনের নাম্বারগুলোতে ফোন করেছিলেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা, যার বয়স ৪২। প্রথমে প্রচন্ড জ্বর এবং দুদিন পর থেকেই কাশি শুরু হয়। আইইডিসিআরের হটলাইনে কয়েকবার ফোন করার পর পরামর্শ আসে, ‘আপনার পরীক্ষা করতে হবে না। বাসায়ই থাকেন।’ আরও টুকটাক পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর ওই ব্যক্তির শরীর আরও খারাপ হতে থাকে। তার পরিবার থেকেও ফোন দেওয়া হয়। শেষে ২৫ এপ্রিল ওই ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সকালে এক চিকিৎসক আত্মীয়ের সহায়তায় তিনি মুগদা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর মুগদা হাসপাতাল থেকেই নমুনা পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়। শুক্রবার তার করোনা পজিটিভ হয়েছে বলে জানা যায়। এখন তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। তার পরিবারের অভিযোগ, প্রথম দিন যদি টেস্ট করা হতো তাহলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হতো না। তারা জানান, আইইডিসিআরে হটলাইনগুলোতে ঢোকাই যায় না।
মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক রোগীর আত্মীয় জানান, বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়েছে ১৮ এপ্রিল। আর গতকাল বুধবার ফলাফল পজিটিভ এসেছে। এর মধ্যে কন্ট্রোল রুমে ফোন করে আমরা জানার চেষ্টা করেছি, টেস্টের রেজাল্ট কী। কোথায় যোগাযোগ করব। কেউ কিছু বলতে পারেনি। শুধু বলে আপনার মোবাইল বা ইমেইলে ফলাফল চলে যাবে। রোগীর অবস্থা খারাপ বলার পরও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। গতকাল সকালে তার ফলাফল পজিটিভ আসে এবং তিনি মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। এর মধ্যে তিনবার কাল আসছি নমুনা নিতে এই বলে তাদের বসিয়ে রেখেছেন আইইডিসিআরের লোকজন।
একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক শাহনেওয়াজ। ২১ এপ্রিল থেকে জ¦র ও শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছিলেন। প্রথমে মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়ে এবং বেশকিছু টেস্ট করান। কিছুই পাওয়া যায়নি। চিকিৎসকরাই বললেন, করোনা টেস্ট করানো জরুরি। অনেক টেলিফোন ও আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনাকে ফোন করে এবং মেসেজ পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত ২৫ এপ্রিল তার মিরপুর পল্লবীর কালশী থেকে স্যাম্পল নিয়ে যায়। এরপর গত পাঁচ দিন হয়ে গেছে পরীক্ষার ফলাফল আসছে না। শাহনেওয়াজ বেশ কয়েকবার আইইডিসিআরের কন্ট্রোল রুমে ফোন দিয়ে জানতে পারেন, এখনো রিপোর্ট তাদের কাছে আসেনি। শেষ পর্যন্ত শাহনেওয়াজ স্যাম্পল সংগ্রহকারীকে ফোন দেন। তিনি জানান, স্যাম্পল তিনি সেদিনই দিয়েছেন। রিপোর্ট আইইডিসিআরের কাছে জমা হয়। তারা ছাড়লেই রোগীকে জানানো হয়। এ অবস্থায় শাহনেওয়াজ গতকাল আবার সেব্রিনাকে এসএমএস পাঠান। এরপরই হেল্প সেন্টারে ফোন দিলে সেখান থেকে জানানো হয়, আরও দুদিন সময় লাগবে। তারা জানিয়েছে, রিপোর্ট এখনো সম্পন্ন হয়নি।
সহকর্মীর করোনা পজিটিভ হওয়ায় বেসরকারি টিভি চ্যানেল দীপ্ত টিভির সিনিয়র রিপোর্টার মাহমুদ শাওনসহ কয়েকজন হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। তাদের অনেকের নমুনা নিয়ে গেছে আইইডিসিআর। শাওন গতকাল এ প্রতিবেদককে জানান, ২৪ এপ্রিল তার নমুনা সংগ্রহ করা হলেও এখন পর্যন্ত রিপোর্ট দেয়নি। রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় আছেন। আইইডিসিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল বলেন, শুরু থেকেই এ ঘটনাটি ঘটছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি টেস্টের ফলাফল পাওয়া যায়, তাহলে অনেক রোগী তাড়াতাড়ি সেরে ওঠেন। তাদের অসুস্থতার হিস্ট্রি জেনে পরামর্শ দেওয়া যায়। তিনি বলেন, শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও এরকম সমস্যা হচ্ছে। অনেকের নমুনা সংগ্রহ করার পর মারা যাওয়ার তিন দিন পর রিপোর্ট এসেছে করোনা পজিটিভ। তিনি এর জন্য প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের একগুঁয়েমিকে দায়ী করেন।
আইইডিসিআরের হটলাইনে ফোন করে বেশিরভাগ সময়ই অবজ্ঞা অবহেলার অভিযোগ উঠছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শামীম আরা শিউলি তার ফেইসবুকে লিখেছেন, ১৯ এপ্রিল বিকেল থেকে জ¦র, কাশি, সর্দিতে ভুগলাম। প্রথম কয়েক দিন বিছানা থেকে মাথাই তুলতে পারিনি। এখন ভালো আছি, কেবল শরীরটা দুর্বল। পপুলার ল্যাব থেকে লোক এনে ডেঙ্গি টেস্ট করিয়েছিলাম, নেগেটিভ এসেছে। তবে ব্লাডসেল কাউন্ট থেকে পরিষ্কার, কোনো একটা সংক্রমণ ছিল। সচেতন নাগরিক হিসেবে আইইডিসিআরের হটলাইনে ফোন দিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি, তার মতে আমার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৩০%। বাসাতেই বিশ্রাম করতে বললেন এবং আরও বলেছিলেন আমি চাইলে তারা নমুনা সংগ্রহের জন্য লোক পাঠাবে, আমি বললাম চাই, ডাক্তার জানালেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের লোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সেই ২৪ ঘণ্টা শেষ হয়েছে আরও তিন দিন আগে। আমি অবশ্য তাতে অখুশি নই এবং আমার ডাক্তার, যিনি সময়ে অসময়ে ফোনে পরামর্শ দিয়েছেন, বলেছিলেন শ্বাসকষ্ট না হলে আইইডিসিআরে ফোন করার দরকার নেই। বাসাতে থেকেই যেন তার নির্দেশনা মেনে চলি, তাই করেছি। আমার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, আমাকে যেন হাসপাতালে না যেতে হয়।
গত ১৮ এপ্রিল থেকে জ্বর এবং সর্দি-কাশি। নারায়ণগঞ্জ সদর জেনারেল হাসপাতালের একজন আউটসোর্সিং স্বাস্থ্যকর্মীর নমুনা সংগ্রহের ১১ দিন পর ফল এসেছে। তাতে ওই স্বাস্থ্যকর্মীর করোনা পজিটিভ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যরা জানান, ১১ দিন পর ফল এসে কী হয়। ততদিনে কোনো ক্রিটিক্যাল রোগী তো মারাই যেতে পারে।
আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, সব হটলাইন খোলা রয়েছে। সবার ফোন রিসিভ করা হয় এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়। তিনি একটি মিটিংয়ে রয়েছেন, পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, আইইডিসিআর শুরু থেকেই টেস্টসহ করোনার সবকিছু নিজেদের কাছে রাখতে চেষ্টা করছে। তাদের এই একক কর্তৃত্বের কারণে অনেককে প্রাণ দিতে হচ্ছে। তাদের হাত দিয়ে ছাড়া কোনো রিপোর্ট ছাড় করা যাবে না। দেখা গেছে, ১১ দিন পর একজনের পজিটিভ পাওয়া গেল। হয়তো এর মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু তিনি কত মানুষের সঙ্গে মিশেছেন সেটিও আর ট্রেস করা যাবে না। এখন উচিত হলো, সবখানে পরীক্ষা এবং যত তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দেওয়া যায় তাই করা। পরীক্ষা বাড়িয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করাই আমাদের বাঁচার একমাত্র উপায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই টেস্ট রিপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে।