ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিন ও রাষ্ট্রের লজ্জা!
ভিক্ষা একটি সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ভিক্ষা নিষিদ্ধ। সেই ধারা অনুযায়ী শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গান্ধীগাঁও গ্রামের নাজিমুদ্দিন একজন অপরাধী। সমাজ তাকে ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু নাজিমুদ্দিন ছিলেন নিরুপায়। দিনমজুরি করতে গিয়ে ৮–৯ বছর আগে তাঁর পা ভেঙে যায়। সেই থেকে ভিক্ষা করে সংসার চালাচ্ছেন। কিন্তু করোনা সংকটকালে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, তা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকেই লজ্জা দিয়েছে।
যখন রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিরা হাজারও নিজামুদ্দিনের পেটে লাথি মেরে খাবার চুরি করে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখছে ঠিক সে সময় একজন নিজামুদ্দিন নিজের সঞ্চয়ের সামান্য টাকা সবার মুখে খাবার দেওয়ার জন্য তুলে দিয়েছেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সাহায্য করতে ধনী হতে হয় না, ইচ্ছা থাকলে গরিব ও নিঃসম্বল মানুষও কিছু করতে পারে। একজন ভিক্ষুক যখন ক্ষুধার্থ মানুষকে দান করছে তখন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের পেটে লাথি মেরে ভিনদেশে খাবার পাটাচ্ছেন।
করোনা সংকটের আগে রাষ্ট্র, সরকার ও জনপ্রতিনিধি—কেউ তাঁর খোঁজ নেয়নি। নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রের খোঁজ নিয়েছেন। তাঁর সঞ্চয়ে যে সামান্য টাকা ছিল, তা ত্রাণের কাজে সহায়তার জন্য রাষ্ট্রকে দান করেছেন। এত দিন ভদ্র সমাজ ‘ভিক্ষুক’ বলে যাঁকে অবহেলা করেছে, তিনিই হয়ে উঠেছেন বিপদের বন্ধু—পথপ্রদর্শক। জীর্ণ দেহের মানুষটিই আমাদের ঘুমন্ত ও ঘুণে ধরা সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চাইলেন কি? জানিয়ে দিলেন, মানুষ বিপদে পড়লে, দেশে দুর্যোগ এলে কী করতে হয়। আমাদের সমাজে বহু বিত্তবান আছেন, মন্ত্রী–এমপি–মেয়র–চেয়ারম্যান আছেন, কিন্তু নাজিমুদ্দিনের মতো কেউ তাঁর সঞ্চয়ের সবটা নিয়ে এগিয়ে আসেননি।
একটা গল্প মনে পড়ে গেল। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। রাসুলের সহচর রাসুল (সা.)-এর জন্মের দুই বছরের কিছু সময় পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং অনুরূপ সময়ের ব্যবধানে তারা উভয়ে ইন্তেকাল করেন। তাই মৃত্যুকালে আবু বকরের বয়স হয়েছিল রাসুল (সা.)-এর বয়সের সমান। তিনি ছিলেন সম্মানিত কুরাইশ ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও সৎ চরিত্রের জন্য মক্কার সব মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায়, সহায়-সম্বলহীনতায় এবং দুস্থদের সাহায্য করতে তিনি ছিলেন নিবেদিত। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তার কাছে সঞ্চিত ৪০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ইসলামের কল্যাণে তিনি রাসুলুল্লাহর কাছে প্রদান করেন। তাবুকের যুদ্ধে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হলে আবু বকরের কাছে দান করার তেমন কিছুই ছিল না। তাই তিনি ব্যাকুল চিত্তে ঘরে গিয়ে প্রয়োজনীয় আসবাব, কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে চুলার ছাই পর্যন্ত (যুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের ক্ষতস্থানে ছাই উপকারী) রাসুলুল্লাহর দরবারে প্রদান করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এসময় তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ?’ উত্তরে আবু বকর বলেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-কে।’ রাসুল (সা.) ঘোষনা দিলেন আবু বকরের দান সবার শ্রেষ্ট দান।
৮০ বছর বয়সী এই নিজামুদ্দিন দেশের এই ক্রান্তিকালে সে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ভাঙা ঘর মেরামতের জন্য দুই বছর ধরে ১০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। সহায়–সম্বলহীন এক বৃদ্ধের জন্য এটি বড় সঞ্চয়। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন করোনা সংকটের কারণে অনেক মানুষ না খেয়ে আছে, তখন তাঁর জমানো ১০ হাজার টাকার পুরোটাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) হাতে তুলে দিলেন। মহান আল্লাহ হয়তো তাঁর দানও শ্রেষ্ট দান হিসেবে কবুল করবেন।
ভাবতে অবাক লাগে, যে রাষ্ট্রে ভিক্ষুক নিজামুদ্দিন মানুষের না খেয়ে থাকার দৃশ্য দেখতে পান সে রাষ্ট্রের মন্ত্রীরা তখন বলেই চলেন দেশের মানুষ না খেয়ে নেয়। যেই পরিবারে চারজন দিনমজুর, সেই পরিবারকে এত দিন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। তাহলে এই যে ভিজিএফ–ভিজিডি কার্ড, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, দুস্থ ও বয়স্ক ভাতা—সেসব কাদের জন্য? দলের নেতা–কর্মী, চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের আত্মীয়স্বজনের জন্য? সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি কি চাল চুরির জন্য? টিসিবির তেল–ডাল–চিনি কি কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য? আমাদের রাষ্ট্র সব সময় তেলা মাথায় তেল দিতে পছন্দ করে। যুগ যুগ ধরে সেটাই করে আসছে। এ কারণেই নাজিমুদ্দিনদের খবর কেউ রাখত না। অথচ তিনি রাষ্ট্রের খবর রাখতেন।
এর আগে ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে দুস্থ ও অভাবি মানুষের তালিকা তৈরি করছিলেন। তাঁরা নিজামুদ্দিনকেও তালিকাভুক্ত করতে তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র বা আইডি দিতে বলেছিলেন। তিনি রাজি হননি। বললেন, ভিক্ষা করে আমার তো দিন চলে যাচ্ছে, আমার চেয়েও যাঁরা বেশি কষ্টে আছেন, তাঁদের সাহায্য দিন। যে দেশে সরকারি পদক ও সাহায্য পাওয়ার জন্য ভদ্দরলোকেরা তদবিরবাজিতে ব্যস্ত থাকেন, সে দেশে নাজিমুদ্দিন ব্যতিক্রমী উদাহরণ বটে।
যে দেশে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা গরিব মানুষের চাল চুরি করেন, ১০টি মাস্ক ও ১০ ব্যাগ খাবার বিতরণের জন্য ১৫ জন দাতা ক্যামেরার সামনে দাঁত কেলিয়ে হাসেন, সে দেশে নাজিমুদ্দিনের নাম সত্যিকার মানবদরদি হিসেবে লেখা থাকবে। তাঁর এ দান ছিল শর্তহীন। জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে চুক্তি থাকে, সেটি রাষ্ট্র পালন না করলেও, একজন নাগরিক হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। সমাজে এ রকম মানুষ আরও আছে। ভদ্দরলোকেরা যাঁদের খোঁজ রাখেন না।
রাষ্ট্র কল্যাণকামী হলে ৮০ বছর বয়সে কাউকে ভিক্ষা করতে হয় না। রাষ্ট্র তাঁর থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্র কল্যাণকামী হলে জনপ্রতিনিধি হয়ে কেউ গরিবের হক মেরে দিতে পারেন না। আওয়ামী লীগের নেতারা সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ ‘সমাজতন্ত্র’ পুনঃস্থাপন করার কৃতিত্ব দাবি করেন। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মসূচির ফারাকটা কোথায়, জিজ্ঞেস করলে তা বলতে পারেন না। সমাজতন্ত্র অনেক দূরের বিষয়। সরকার অন্তত এটুকু নিশ্চয়তা দিক যে ৮০ বছর বয়সে দেশের কোনো নাগরিককে ভিক্ষা করতে হবে না। নাজিমুদ্দিন ভিক্ষার টাকা রাষ্ট্রকে দান করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু রাষ্ট্র তার লজ্জা ঢাকতে পারেনি। –রুদ্র আহনাফ