সড়কে জট, বাজারে ভিড়, লকডাউন তাহলে কার জন্য?
ঢাকার অলি-গলির সড়কে রিকশার জট। মানুষের জটলা। প্রধান সড়কে দাপিয়ে চলছে প্রাইভেট গাড়ি। চেক পয়েন্টে আটকালে নানা অজুহাত। কেউ হাসপাতাল, কেউ বাজারের কথা বলে পার পাচ্ছে। নগরীর প্রধান সড়কের একটি সিগন্যালে বুধবার ক্ষণিকের জন্য যানজট লেগেছিল এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। কাঁচাবাজারে পা রাখা যায় না। ঠিক আগের চিত্রই।
করোনা মহামারীর মধ্যেই মানুষের খাবারের চাহিদা যেন বেড়ে গেছে। নাহলে এভাবে ভয়ঙ্কর করোনার মধ্যে মানুষ বেহুশ হয়ে বাজারে নামে? মুখে একখানা মাস্ক দেয়ারও প্রয়োজন মনে করছে না অনেকে। না ক্রেতা না বিক্রেতা সবাই বেহুশ। সামাজিক দূরত্ব ? এটি শুধু শ্লোগানেই সীমাবদ্ধ। একজনের গায়ের ওপর উঠে আরেক জন পণ্য কিনছে। কিছু জায়গায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন বাজারের জন্য খোলা জায়গা ঠিক করে দিয়েছে। ক্রেতা বিক্রেতার সেখানে যেতে অনীহা। গিঞ্জি কাওরান বাজারে ছয় জনের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। সতর্কতার অংশ হিসেবে বাজারে খুচরা বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
কার্যত সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এ বাজার বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু থাকছে কি? বুধবার ভিডিও চিত্রে দেখা গেলো দিনের বেলা বাজারে দোকানপাট খোলা। ক্রেতারা যাচ্ছেন। অনেকটা ভিড়ের পরিবেশ। মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার সরিয়ে পাশের মাঠে নেয়া হয়েছে। তবে সেখানে যেতে চান না বিক্রেতারা। কেউ দোকান নিয়ে বসেছিলেন। কেউ অপেক্ষায় আগের জায়গায় ফেরার। পল্লবীর দুয়ারিপাড়ার বাজারটি ছিল সরকারি জায়গায়। উচ্ছেদের পর এখন বসে প্রধান সড়কে। সকাল হলেই সড়কটি কানায় কানায় ভরে যায় ক্রেতা-বিক্রেতায়। দূরত্বের বালাই নেই এখানে । সড়কে রিকশা, ভ্যানে গিজ গিজ করে। আশপাশে ভাসমান মানুষদের জটলা। সুপারশপগুলোতে পা রাখার জায়গা নেই। পণ্য বাছাই, বিল দেয়ার সময় একজন আরেক জনের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে।
শুধু কি ঢাকা? গ্রামের চিত্র আরও ভয়াবহ। ব্যাটারি চালিত যানে গাঁদাগাঁদি করে ৮/১০ জন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। বাজারে মানুষের স্রোত। কোথাও কোথাও বাজারের স্থান পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন হয়নি। আমাদের জেলা, উপজেলা প্রতিনিধিদের তথ্য, কোন কোন বাজার দেখলে মনে হয় এখন কোন উৎসব চলছে। ছুটির আমেজে মানুষ বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চায়ের দোকানে সমানে চলছে আড্ডা। তরুণরা জটলা পাকাচ্ছে এখানে সেখানে।
দীর্ঘ এক মাস ধরেইতো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কর্মসূচি চলছে। তৎপর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাঠে দিন রাত চষে বেড়াচ্ছেন তারা। এরপরও এমন চিত্র কেন?
আসলে তারা কেউই বসে নেই। কেবল ‘বেহুশ’ মানুষের হুশ ফিরছে না। বাজারে পুলিশ-র্যাব, সেনা সদস্যরা টহলে গেলে মুহুর্তে খালি হয়ে যাচ্ছে। আড়ালে আবডালে গিয়ে উঁকি মেরে তাদের অবস্থান দেখছে ‘কৌতুহলী’ মানুষ। টহল দল বাজার ছাড়লেই আবার বীরদর্পে এসে বিজয়ের হাসি হাসছে। সড়কে গাড়ি-বাইক নিয়ে নামা মানুষ নানা অজুহাত দাড় করাচ্ছে। মায়ের জন্য ওষুধ কেনা, শিশুর খাবার, রোগী দেখা।
অজুহাতের কোন শেষ নেই। সঙ্গে পুরনো প্রেসক্রিপশনসহ নানা ‘প্রমাণাদি’ থাকছে। নিজের নিরাপত্তা তুচ্ছ ভেবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যটি সড়কে দাড়িয়ে মানুষের নিরাপত্তার কথা ভাবছেন তিনি কি এতোসবের যাচাই করতে পারবেন? চলমান লকডাউন আরও দীর্ঘ হয়েছে। কিন্তু মানুষের যদি বোধোদয় না হয় তাহলে ছুটি বাড়িয়ে কি লাভ? করোনায় দেশে দেশে কান্না বাড়ছে। লাখে লাখে মানুষ আক্রান্ত। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবাণী করোনা অনেক দেশে এখনও প্রথম ধাপে। আমাদের দেশে কোন ধাপে সেটা হয়তো কেউ বলতে পারবে না। এটি প্রথম ধাপ হলে দ্বিতীয় ধাপের চিত্র কেমন হবে কারও আন্দাজে নেই। দেশে ৯০ ভাগ এলাকায় করোনা ছড়িয়েছে। ৫৮ জেলায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে রোগী, মৃত্যু। নিরাপদ শহর-এলাকাটি এক দিনেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে। সকালে উন্মুক্ত থাকা পাড়ার গলিটি বিকালে লকডাউন হয়ে যাচ্ছে। এমন সময়েও মানুষের মাঝে অস্থিরতা। এই অস্থিরতা সামনে যে ভয়ঙ্কর বিপদের কারণ হতে যাচ্ছে এটি বোধ হয় কারও ধারনায় নেই।