মুসলমান কখনও গুজব রটাতে পারে না
ফয়জুল্লাহ আমান
তিনটা থানকুনি পাতা খেলেই করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তিন কাপ গরম চা পান করলেই করোনাভাইরাস সেরে যাবে। মুসলমানদের কখনও করোনাভাইরাস আক্রান্ত করবে না।
এ ধরনের অসংখ্য গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের সুযোগের কারণে অতি দ্রুততার সঙ্গে একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।
এর সুফল যেমন ভোগ করছি আমরা, অনেক সময় এই গতি ব্যবহৃত হচ্ছে মন্দ ক্ষেত্রেও।
সঠিক সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে অনেক গুজবের কারণে সমাজে চরম বিশৃংখলাও দেখা দেয়। গুজবগুলো এক সময় মিথ্যা হওয়ার বিষয়ে সবার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায় কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই যায়।
এর আগে ২০১৩ সালে দেলাওয়ার হুসাইন সাইদিকে চাঁদে দেখা গেছে বলে একটি গুজব রটে যায়। মধ্যরাতে উত্তরবঙ্গে কয়েকটি গ্রামের মসজিদের মাইক থেকে এমন কথা রটানো হয়।
গ্রামের ওয়াজ শোনা সাধারণ মানুষ মনে করে এ হয়ত আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ইশারা। এখনই সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে হবে। পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলা করে বসে গুজবাক্রান্ত মানুষ। অসংখ্য মানুষ নিহত হয় সে ঘটনায়। রীতিমতো এক বিভীষিকার রূপ নেয় ঘটনাটি।
করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর নানা মিথ্যা সংবাদ ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচারিত হয়েছে। এর ভেতর সবচে বিখ্যাত হয়ত করোনাভাইরাসের সঙ্গে তিন ঘণ্টা কথোপথন বিষয়ক একটি স্বপ্নের বৃত্তান্ত।
এ ছাড়া রয়েছে ইমাম মাহদি ও দাজ্জাল বিষয়ক গুজব। আর রয়েছে মানবসৃষ্ট ভাইরাস হওয়ার বিষয়ে নানা তত্ত্ব। উৎস ছাড়া এমন অসংখ্য খবর ভাইরাল হয়েছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আমরা আজকে আলোচনা করব, এ ক্ষেত্রে একজন মুসলিমের কর্তব্য কী হবে?
প্রত্যেক মুসলিম একজন দায়িত্বশীল নাগরিক। নবীজী সা. ইরশাদ করেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকের দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। [বুখারী, মুসলিম]
কাজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবগুলোর ব্যাপারে একজন মুসলিমকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে গুজব রটানো মুনাফিকদের কাজ। [সূরা আহযাব আয়াত: ৬০] মুনাফিকরা মদীনা মুনাওয়ারায় গুজব ছড়াত।
মুনাফিকের তিনটি আলামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বুখারী শরীফের হাদীসে। ওয়াদা ভঙ্গ করা, ঝগড়া করা এবং মিথ্যা বলা। কাজেই যারা বিভিন্ন গুজব সৃষ্টি করেন তাদের বুঝতে হবে আপনি এর দ্বারা মুমিন থেকে মুনাফিক হয়ে যাচ্ছেন। মুমিন কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা বলে না।
মূলত গুজব রটায় কে? যার নৈতিক কোনো দৃঢ়তা নেই। চারিত্রিকভাবে যে হীন এবং নীচ সেই ভিত্তিহীন কথা সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে।
গুজব রটায় সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির উদ্দেশে। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের জন্য। আবার কোনো কারণ ছাড়া মজা করার জন্যও গুজব ছড়ায়। বর্তমান সময়ে সাবস্ক্রাইবার বা ভিউ বাড়ানোর জন্যও অনেকে বিভিন্ন চটকদার ভিত্তিহীন গুজব রটানোর কাজটি করে।
কিছু মানুষ আছে যাদের ভেতর মিথ্যা কথা রটানোর রোগ রয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই তারা বিভিন্ন মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে বেড়ায়। তারা মূলত কোনো সুস্থ মানসিকতার মানুষ নয়।
এ সব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের চোখ রাখা উচিত যে কোনো সংবাদে। যাচাই করার মতো একটা মানসিকতা হয়ে গেলে কিছু দিনেই আপনি সংবাদের ধরন দেখেই বলে দিতে পারবেন এটার কোনো ভিত্তি আছে কি নেই। ভিত্তিহীন সংবাদ এড়িয়ে চলা তখন আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।
এটা চর্চার বিষয়। এর জন্য আপনাকে অনেক বড় গবেষক হতে হবে না। সামান্য মনোযোগই যথেষ্ট। যাচাই করার জন্য সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে সংবাদের উৎস দেখতে হবে আপনাকে।
কোন উৎস থেকে সংবাদটি পেলেন আপনি। যদি দেখেন অচেনা-অজানা একটি উৎস। তাহলে সেটির ভেতরে প্রবেশ করুন। প্রোফাইল ঘাটুন। ফলোয়ার সংখ্যা দেখে ধোকায় পড়বেন না। বিভিন্নভাবে ফলোয়ার বাড়ানো যায়। তার পরিবেশিত সংবাদগুলোর চরিত্র দেখুন।
দেখবেন অতীতে সে আরও বহু সংবাদ পরিবেশন করেছে যেগুলো ভুল হওয়া প্রমাণিত হয়ে গেছে। এমন মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করবে যারা, তাদের গুরুত্ব আপনার কাছে তখন এমনিতেই কমে আসবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আপনাকে ভাবতে হবে এটার সম্ভাব্যতা কতটুকু। যত রং চং লাগিয়েই উপস্থাপন করা হোক না কেন আপনি দেখবেন এটা বাস্তবে সম্ভব কি না। সন্দেহ করতে অভ্যস্থ হোন। এত সরলতা নিয়ে সমাজে বাস করতে পারবেন না।
আপনি যদি দেখেন সংবাদে লিখছে, যে কোনো মুহূর্তে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। একটি গ্রহ পৃথিবীর বায়ূমন্ডলের কাছে ঘোরাঘুরি করছে।
এ ধরনের সংবাদ দেখলেই আপনার কি মনে হয় না কেমন অস্বাভাবিক?
চটকদার সংবাদ পেয়েই শেয়ার করবেন না। তাতে আপনি আল্লাহর খাতায় মিথ্যাবাদি হিসেবে নথিভুক্ত হয়ে যাবেন। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, একজন মানুষ মিথ্যাবাদি হওয়ার জন্য এই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তাই বলে বেড়ায়। [মুসলিম শরীফ] সব শোনা বা দেখা সংবাদ সত্যাসত্য যাচাই ছাড়া শেয়ার করলে আপনি এ হাদীসের ভাষ্যানুসারে মিথ্যুক সাব্যস্ত হবেন।
বুখারী শরীফের অন্য হাদীসে রাসূল সা. বলেন, তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক; কারণ মিথ্যা পাপের পথ দেখায়। আর পাপ জাহান্নামের পথ দেখায়। একজন মিথ্যা বলতে বলতে এমন অবস্থা হয় যে, আল্লাহর কাছে তার নাম মিথ্যাবাদিদের ভেতর লেখা হয়।
আজকের সমাজে মিথ্যার প্রসার সীমা ছাড়িয়েছে। মিথ্যা থেকে খুব কম মানুষই বাঁচতে পারে। এমতাবস্থায় একজন মুসলিমকে খুব সতর্ক হতে হবে। কারণ মুসলিম কখনও মিথ্যা প্রসারে সহায়ক হতে পারে না।
গুজব বানানো যেমন অপরাধ গুজব রটানো গুজবে কান দেয়া এবং গুজব শেয়ার করাও অপরাধ। মিথ্যার এক জঘন্যতম রূপ গুজব। সব ধরনের মিথ্যাই হারাম। গুজব ছড়ানো আরও বড় হারাম।
এ হারাম থেকে আমাদের অবশ্যই বাঁচতে হবে। আল্লাহ আমাদের সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন গুজব এড়িয়ে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।