মহামারিতেও থেমে নেই ধর্ষণের প্রকোপ
মনিরা নাজমী জাহান
ধর্ষণ আজকের সমাজের এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধির নাম। যে ব্যাধি সমাজকে প্রতিদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ভয়াবহ ব্যাধিটি যাদের মাধ্যমে বিস্তার ঘটছে সেই সব ধর্ষক একেকটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব। এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবদের হাত থেকে রক্ষা নেই সমাজের যেকোনো বয়সী নারীদের। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না এই ধর্ষক নামক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবদের।
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে মানবজাতি যখন প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের কাটছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সাথে যখন করোনা নামক মহামারি বাতাসের সাথে ছড়িয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতার আলো, মানুষ যখন প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে ঠিক এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিও থামিয়ে দিতে পারেনি ধর্ষক নামক দানবদের। এমন ক্রান্তিলগ্নেও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সমাজ। কখনো ৯ বছরের শিশু, কখনো প্রতিবন্ধী বালিকা কখনো বা কিশোরীকে ২৫ দিন আটকে রেখে করা হয়েছে নির্যাতন। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্যেই গত ১০ দিনে ঢাকা মহানগরে ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও অপহরণের ২৮টি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ৩৭ জন।
সর্বপ্রথম আমাদের বুঝতে হবে ধর্ষণ কী? এক কথায় বলতে গেলে ধর্ষণ এক ধরনের যৌন আক্রমণ। একটু বুঝিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় সাধারণত, একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে। অনুমতি প্রদানে অক্ষম (যেমন- কোনো অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি) এ রকম কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়াও ধর্ষণের আওতাভুক্ত।
অপরাধবিজ্ঞানী জেরেমি বেনথাম এবং সিজার বেকারিয়ার মতে, কোনো অপরাধী অপরাধ সংঘটিত করার আগে সেই কৃত অপরাধের কারণে প্রাপ্ত আনন্দ এবং সেই অপরাধ কারণে প্রাপ্ত শাস্তিকে মাথায় রেখেই সেই অপরাধ সংঘটিত করে। যেহেতু ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সুতরাং একজন ধর্ষক এমন ভয়াবহ শাস্তির ভয়ে ধর্ষণ থেকে নিজেকে বিরত রাখার কথা এবং সমাজে ধর্ষণের হার কমে যাওয়ার কথা কিন্তু প্রকৃত চিত্র তার উল্টো, ধর্ষণের হার তো কমেইনি বরং উদ্বেকজনকভাবে বেড়ে চলছে।
কিন্তু কেন? এর কারণ হচ্ছে লজ্জাজনকভাবে, বহু বছর ধরে, ধর্ষণকে একটি সম্পত্তিগত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পুরুষরা নারীদের নিজেদের ভোগপণ্য বা নিজের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেই বিকারগ্রস্ত বিবেচনাবোধ থেকে তারা আগ্রাসী হয়ে নারীদের দমন করার জন্য তাদের লিঙ্গকে নারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যতক্ষণ না পর্যন্ত পুরুষরা নারীদের নিজস্ব সম্পত্তি বা ভোগ্যপণ্য ভাবা বন্ধ না করবে ততক্ষণ এই জঘন্য অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল সম্ভব নয়।
একজন ব্যক্তির ধর্ষক হওয়ার পেছনে সমাজের কিছু বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যে প্রশ্নটি উত্তর আমাদের সর্বপ্রথমে জানতে হবে তা হলো- সমাজের কোন কারণগুলো একটি ব্যক্তিকে ধর্ষণ করার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সমাজবিজ্ঞানী ল্যারি ব্যারন এবং মারে এ স্ট্রাসের মতে, মূলত চারটি কারণ পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে- ১. লিঙ্গবৈষম্য ২. পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা ৩. সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও ৪. সামাজিকভাবে বৈধ সহিংসতা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধর্ষণ সমাজকে নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নারীবাদীরা মনে করেন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের ভয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এবংলিঙ্গবৈষম্য প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। এই সমাজের এখনও নারীকে দুর্বল ও অবলা হিসেবে ধরা হয় যেখানে তার প্রধান কাজ হচ্ছে সন্তান জন্ম দেয়া।পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এইসব আধিপত্ত্যবাদ এবং আগ্রাসীমূলক আচরণ পুরুষদের যৌন নির্যাতনের বিষয়ে এক ধরনের উৎসাহ প্রদান করে।
পর্নোগ্রাফি তত্ত্ব অনুযায়ী পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা ধর্ষককে ধর্ষণের বিষয়ে উৎসাহিত করে। পর্নোগ্রাফিতে সাধারণত নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য এবং নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয় যা ধর্ষণের ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করে। পর্নোগ্রাফির আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো- এখানে দেখানো হয় নারী তার প্রতি ঘটে যাওয়া প্রতিটি অমানবিক এবং নিষ্ঠুর যৌন নির্যাতনকে খুব সাদরে গ্রহণ করছে। যেটি সমাজে খুব বাজেভাবে প্রভাব ফেলে।
সামাজিক বিশৃঙ্খলা তথা দেশান্তর, দাম্পত্য কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়গুলো ধর্ষণকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। সামাজিকভাবে বৈধ সহিংসতা যেমন এখনো দেশে অনেক অঞ্চলে নারীর গায়ে হাত তোলাকে পুরুষের বৈধ অধিকার বলে মনে করে, গরিব ঘরের মেয়ের প্রতি ধনী ব্যক্তির লোলুপদৃষ্টিকে অন্যায় বলে মনে করে না। এই ধরনের সামাজিকভাবে বৈধ সহিংসতা সমাজে ধর্ষণ উসকে দেয়। এ তো গেল সামাজিক প্রভাবক, এবার লক্ষ করা যাক ব্যক্তির ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর প্রতি। সাধারণত কোন কোন ব্যক্তিগত ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটি মানুষকে ধর্ষণের প্রতি প্রলুব্ধ করে। সেটি নিরূপণ করাও সমভাবে জরুরি।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, একজন ব্যক্তির শারীরিক ত্রুটি এবং অক্ষমতার কারণে তার যে মানসিক অবক্ষয় ঘটে তাও অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং যেসব ব্যক্তি শারীরিক বিকৃতির কারণে ঘৃণা ও উপহাসের মুখোমুখি হন তাদের মধ্যে প্রায়শই আরও বেশি অপরাধ প্রবণতা জন্মাতে থাকে। তেমনি যে সমস্ত ব্যক্তি তাদের কুৎসিত অবয়বের কারণে সমাজে ঘৃণা ও উদাসীনতার স্বীকার হন তারা একপ্রকার হীনম্মন্যতায় ভোগেন এবং তাদের এই হীনম্মন্যতার কারণে তারা অনেক সময় যৌন নির্যাতনের মতো ভয়ানক অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
শারীরিক ত্রুটি ছাড়াও অসফল বৈবাহিক জীবন, সঙ্গিহীনতা, হতাশা, ক্রোধ বা মানসিক অস্থিরতাও মানুষকে যৌন নির্যাতনমূলক অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। প্রফেসর লিন্ডস্মিথের মতে, মাদকাসক্তি ও যৌন নির্যাতনের অন্যতম কারণ। মাদকাসক্তি অনেক সময় যৌনউদ্দীপনা ঘটায় তখন একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধে লিপ্ত হয়।
১৯৭৯ সালে, নিকোলাস গ্রোথ কর্তৃক রচিত ‘মেন হু রেপ: দ্য সাইকোলজি অব অফেন্ডার’ নামক গ্রন্থে ধর্ষণকে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশজনিত আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি তার গ্রন্থে আরও বলেন, একজন ধর্ষক তার তীব্র রাগ, ক্ষোভ হতাশা ও বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে ধর্ষণ করে থাকে। নিকোলাস গ্রোথই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে মূলত ধর্ষণের তিনটি প্রধান উপাদান তথা: শক্তি, ক্রোধ এবং যৌনতা সমন্বয়ে চার প্রকারের ধর্ষক সমাজে সৃষ্টি হয়।
প্রথম প্রকারের ধর্ষক, এরা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সাধারণত ধর্ষণে লিপ্ত হয়। পারিবারিক জীবনে সমস্যা, পেশাগত সমস্যা, অর্থনৈতিক দুর্যোগ প্রভৃতি সমস্যার কারণে তাদের জীবনে মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হয় এবং সেই হতাশা এবং ক্ষোভ থেকে এই প্রকারের ধর্ষক ধর্ষণে লিপ্ত হয়। দ্বিতীয় আরেক প্রকারের ধর্ষক আছে যারা নারীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ধর্ষণ করে থাকে।
তৃতীয় প্রকার ধর্ষকের মধ্যে রয়েছে যারা অন্যকে আঘাত করে বা কষ্ট দিয়ে আনন্দ লাভ করার জন্য ধর্ষণ করে। সর্বশেষ প্রকার ধর্ষকদের বলা হয় সুযোগসন্ধানী ধর্ষক এরা সাধারণত সুযোগ বুঝে ধর্ষণ করে।
এই চার প্রকার ছাড়াও আরও দুই প্রকারের ধর্ষক সমাজে দেখা যায়। এদের মধ্যে এক প্রকারের ধর্ষক চেষ্টা করে ধর্ষণের পর ভিকটিমের সাথে সহানুভূতি দেখিয়ে ভিকটিমকে ম্যানেজ করতে। আরেক ধরনের ধর্ষক ঠিক তার উল্টা আচরণ করে ভিকটিমের সাথে। এরা ধর্ষণের পর ভিকটিমকে প্রতিনিয়ত হুমকি-ধামকি দিতে থাকে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য আইন রয়েছে; তবে একমাত্র আইনই এই অমানবিক অপরাধকে নির্মূল করতে পারে না । নির্মূল করতে হলে অবশ্যই অপরাধের মূলে গিয়ে সমাজ থেকে সমূলে এই ব্যাধিকে বিনষ্ট করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন ধর্ষিতার বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন।
মনে রাখতে হবে ধর্ষক অপরাধী, ধর্ষিতা নয়। তাই ধর্ষককে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি সমাজকে ধর্ষিতা নারীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে এবং সমাজে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার বিষয়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষের সমভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।